গর্ভাবস্থায় ভিটামিন: মা ও শিশুর জন্য অপরিহার্য পুষ্টি
গর্ভাবস্থায় প্রতিটি মায়ের শরীরের ওপর বাড়তি চাপ থাকে এবং একই সঙ্গে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির স্তরও বজায় রাখতে হয়। এ সময় পুষ্টির সঠিক ব্যবস্থা গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ বিকাশ এবং মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টি গ্রহণ না করলে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা যেমন, প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং শিশুর জন্য বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের খাদ্যতালিকা ঠিকভাবে সাজানো হলে তা শুধু মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, শিশুর উন্নতির জন্যও অপরিহার্য। এ সময় বিশেষ করে ভিটামিন, মিনারেলস, প্রোটিন, চর্বি এবং কার্বোহাইড্রেটের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। এই উপাদানগুলি শিশুর সঠিক বৃদ্ধি এবং মায়ের শারীরিক ক্ষমতার জন্য সহায়ক।
গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় প্রধান ভিটামিন ও তাদের তাদের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. ভিটামিন A
গর্ভাবস্থায় ভিটামিন A মায়ের এবং শিশুর চোখের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় ভিটামিন A-এর অভাব অনাগত শিশুর চোখের সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই শিশুর দৃষ্টিশক্তির উন্নয়ন এবং চোখের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এই ভিটামিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এটি শিশুর ইমিউন সিস্টেমের উন্নতি ঘটায় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। সর্বোপরি ভিটামিন A শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাজর, পালং শাক, লালশাক, ডিমের কুসুম, কুমড়া, বিভিন্ন রঙিন শাক-সবজি ইত্যাদি ভিটামিন এ এর ভালো উৎস। তবে ভিটামিন এ একটি চর্বি-দ্রবণীয় ভিটামিন এবং এর অতিরিক্ত মাত্রা মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই গর্ভবতী বা দুগ্ধদানকারী মায়ের ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে অবশ্যই একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।১
২. ভিটামিন B কমপ্লেক্স
ফোলিক অ্যাসিড (ভিটামিন B9):
ফোলিক অ্যাসিড গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনগুলির মধ্যে একটি। এটি নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটি) প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। এই ভিটামিনটি গর্ভধারণের প্রথম কয়েক সপ্তাহে গ্রহণ করলে শিশুর স্নায়ু সিস্টেমের সঠিক বিকাশ সম্ভব হয়। ফোলিক অ্যাসিডের অভাব গর্ভস্থ শিশুর বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
ভিটামিন B12:
ভিটামিন B12 শরীরের স্নায়ুতন্ত্র এবং রক্তের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং মায়ের শক্তির স্তর বজায় রাখে। এটি শিশুদের স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক বিকাশ এবং তাদের শক্তির স্তর উন্নত করতে সাহায্য করে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, বাদাম, বীজ, সবুজ শাকসবজি, মটরশুঁটি, সয়া পণ্য (যেমন সয়া দুধ, সয়াবিন), গোটা শস্য ইত্যাদি ভিটামিন বি এর ভালো উৎস।২
৩. ভিটামিন C
ভিটামিন C একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, যা শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।৩ এটি ইনফেকশন প্রতিরোধে সহায়ক এবং গর্ভাবস্থায় নানা ধরনের সংক্রমণ ও ফ্লু থেকে মা এবং শিশুকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাছাড়া ভিটামিন C আয়রন শোষণে সহায়তা করে যা গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা (এনিমিয়া) প্রতিরোধে অপরিহার্য। আয়রন শিশুর শরীরে রক্ত উৎপাদনে সহায়তা করে এবং মায়েরও রক্তস্বল্পতার সমস্যা এড়াতে সহায়তা করে। ভিটামিন C-এর অভাবে আয়রন শোষণ কমে যেতে পারে, ফলে রক্তস্বল্পতা এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। কমলা, মাল্টা, লেবু, পেয়ারা, কাঁচা আম, টমেটো, মরিচ ইত্যাদি ভিটামিন সি এর ভালো উৎস।
৪. ভিটামিন D
ভিটামিন D শিশুর হাড় এবং দাঁতের বিকাশে অপরিহার্য। এটি ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়িয়ে দেয়, যার মাধ্যমে শিশুর হাড় মজবুত এবং সুস্থ হয়। ভিটামিন D-এর অভাব শিশুদের হাড় দুর্বল এবং ফ্র্যাচারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। তাছাড়া ভিটামিন D ক্যালসিয়ামের শোষণকে বাড়িয়ে দেয় যা মায়ের হাড় এবং দাঁতের সুস্থতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।৪ গর্ভাবস্থায় মায়ের ক্যালসিয়ামের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং ভিটামিন D তার শোষণকে সহজ করে। ডিমের কুসুম, মাশরুম, পনির, কড লিভার অয়েল, মাছের তেল ইত্যাদি খাদ্যে প্রচুর পরিমান ভিটামিন-ডি রয়েছে। তাছাড়া প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি পাওয়ার প্রধান উৎস হলো সূর্যের আলো। সূর্যের আলো আমাদের ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরিতে সাহায্য করে। তবে বেশিক্ষণ কড়া রোদে থাকলে ত্বক লাল হয়ে যাওয়া কিংবা পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রোদে যাওয়ার আগে ত্বকে অন্তত এসপিএফ ১৫ শক্তিমাত্রার সানস্ক্রিন লাগিয়ে নেওয়া উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাভাবিক অবস্থায় ভিটামিন ডি এর কোনো সাপ্লিমেন্ট আলাদাভাবে গ্রহণ করার প্রয়োজন না হলেও যদি শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন ৫ মাইক্রোগ্রাম বা ২০০ ইউআই ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করা যেতে পারে। ১

উপর্যুক্ত ভিটামিনগুলো গর্ভাবস্থায় মায়ের এবং শিশুর শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পাশাপাশি মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করে। এছাড়াও ভিটামিন এ খাবার গ্রহণ করা উচিত। ভিটামিন E দেহকোষ কে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখে। আখরোট, কাঠবাদাম, পেস্তা বাদাম, অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, পালং শাক, ব্রকলি ইত্যাদি খাবার ভিটামিন ই এর ভালো উৎস। সেই সাথে ভিটামিন K রক্তের জমাট বাঁধা প্রক্রিয়া এবং হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় ভিটামিনের অভাব ও তার প্রভাব
গর্ভাবস্থায় পুষ্টির অভাব, বিশেষ করে ভিটামিনের অভাব, মায়ের এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু ভিটামিনের অভাব হলে গর্ভাবস্থায় নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা ভবিষ্যতে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। নিচে গর্ভাবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনের অভাব এবং তাদের প্রভাব আলোচনা করা হলো:
১. ভিটামিন A-এর অভাব
ভিটামিন A-এর অভাবে চোখের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন রাতকানা বা দৃশ্যমানতা কমে যাওয়া, বিশেষত কম আলোতে। গর্ভাবস্থায় ভিটামিন A-এর অভাব মায়ের দৃষ্টিশক্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে চোখের সঠিক বিকাশে সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া এর অভাবে মায়ের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যার ফলে নানা ধরনের সংক্রমণ বা ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেমের দুর্বলতা শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
২. ভিটামিন D-এর অভাব
গর্ভাবস্থায় ভিটামিন D-এর অভাব হলে মা এবং শিশুর হাড় দুর্বল হতে পারে, এবং শিশুর হাড়ের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ভিটামিন D-এর অভাব থেকে মায়ের হাড়ের ক্ষয় বা Osteoporosis হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং শিশুর হাড়ের বৃদ্ধিও সঠিকভাবে হয় না।
৩. ভিটামিন C-এর অভাব
গর্ভাবস্থায় ভিটামিন C-এর অভাবে স্কার্ভি নামক রোগ হতে পারে, যা এক ধরনের রোগপ্রতিরোধের দুর্বলতা ও কোষের অবক্ষয় ঘটায়। স্কার্ভি হলে মাংসপেশি, দাঁত এবং দাঁতের মাড়ির ক্ষতি হয় এবং রক্তক্ষরণ হতে পারে। ভিটামিন C-এর অভাব মায়ের শরীরে ইনফেকশন বা ঠাণ্ডা লাগার সম্ভাবনা বাড়ায় এবং শিশুর উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৪. ভিটামিন B9 (ফোলিক অ্যাসিড) এর অভাব
গর্ভাবস্থায় ফোলিক অ্যাসিড (ভিটামিন B9) এর অভাবে গর্ভস্থ শিশুর নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (NTD) হতে পারে যার কারণে শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্নায়বিক বিকাশে গুরুতর ত্রুটি সৃষ্টি করে এবং অনেক সময় এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় যথাযথ পরিমাণে ফোলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থায় অধিকাংশ ভিটামিনের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়।৫ কিছু ক্ষেত্রে সঠিক পরিমাণে ভিটামিন পেতে সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে যদি খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন পাওয়া না যায়। সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। সঠিক পুষ্টি এবং ভিটামিনের অভাব মায়ের এবং শিশুর স্বাস্থ্যে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই গর্ভাবস্থায় খাবারের প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
তথ্য সুত্র
- Continental Hospitals. (2025, July 7). Prenatal supplements: What to choose for a healthy pregnancy. Continental Hospitals.
- Desai, R. V. (Medically reviewed). (n.d.). ভিটামিন বি 12 খাবার: ফল, সবজি, শুকনো ফল এবং উপকারিতা. Bajaj Finserv Health.
- UNICEF Bangladesh. (n.d.). গর্ভাবস্থায় কী খেতে হবে. UNICEF Bangladesh. https://www.unicef.org/bangladesh/parenting-bd/what-to-eat-when-pregnant
- Continental Hospitals. (2025, January 25). মায়েদের শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব নবজাতকের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে? Continental Hospitals. https://continentalhospitals.com/bn/blog/how-do-low-vitamin-d-levels-in-moms-impact-newborns/
- Bruinse, H. W., & Van den Berg, H. (1995). Changes of some vitamin levels during and after normal pregnancy. european Journal of Obstetrics & gynecology and reproductive Biology, 61(1), 31-37.
