প্রিম্যাচিউরড বেবির যত্ন

গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ আগে জন্ম নেয়া শিশুকে প্রিম্যাচিউরড বেবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত গর্ভকাল ৪০ সপ্তাহ হলে জরায়ুতে ভ্রুণ যথেষ্ট বিকাশ লাভ করে। এসময় ভ্রুণ শিশুর ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গ পরিপূর্ণতা লাভ করে। ফলে সন্তান প্রসবের পর মাতৃজঠর থেকে বেরিয়ে এসে শিশু যে পরিবেশ পায় তার সাথে মানিয়ে নিতে  সক্ষম হয়। কিন্ত একজন প্রিম্যাচিউরড নবজাতক শিশুর শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে বিকশিত না হওয়ায় বাইরের পরিবেশের সাথে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। বিভিন্ন কারণে একজন প্রসূতি মা প্রিম্যাচিউরড বেবির জন্ম দেন –

§  অল্প বয়সে মাতৃত্ব

§  কম সময়ের ব্যবধানে গর্ভধারণ

§  মায়ের পুষ্টিহীনতা

§  গর্ভাবস্থায় মায়ের ইনফেকশন

§  গর্ভাবস্থায় মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ইত্যাদি

প্রি-ম্যাচিওরড বাচ্চার কমন অসুবিধাগুলো

§  শরীরের তাপমাত্রা যেকোন সময় কমে যাওয়া

§  ফুসফুস পরিণত না হওয়ায় শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা

§  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম  হওয়ায় শরীরে বিভিন্ন ইনফেকশন দেখা দেয়া

§  ওজন স্বল্পতা

§  অপুষ্টিতে ভোগা

কেন প্রি-ম্যাচিওরড বাচ্চার বিশেষ যত্ন নিতে হয়:

বিশেষজ্ঞদের মতে, শতকার ৭৫ ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ সেবা নিশ্চিত করা গেলেই অপরিণত নবজাতক শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব । একজন প্রিম্যাচিউরড বেবির ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিণত না হ্ওয়ার পূর্বেই জন্মলাভ করে, কাজেই এই পৃথিবীর আলো বাতাসের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ওকে একজন পরিণত নবজাতকের চেয়েও বেশী সংগ্রাম করতে হয়। এজন্য তার বিশেষ যত্ন প্রয়োজন ।      

(১) হাসপাতালে প্রিম্যাচিউরড বেবির যত্ন:

সাধারণত প্রিম্যাচিউরড বেবি জন্মের পর থেকে নানা জটিলতায় ভুগতে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে তার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে জন্মের পরপরই অপরিণত নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যার জন্য হাসপাতালে আইসিইউ কেয়ারের প্রয়োজন হয় । সেখাতে তাকে কিছুদিন লাইফ সাপোর্টেও রাখতে হতে পারে। এসময় বেবিকে সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধের ব্যবস্থাপনা, অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে প্রয়োজনমত  অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখা,  টিউবের মাধ্যমে বাচ্চাকে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা, শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে কিনা তা প্রতিনিয়ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রিম্যাচিউরড বেবির সুস্থতা নিশ্চিত করতে হয়। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য নবজাতকের জন্য প্রয়োজনমত উত্তাপের ব্যবস্থা রাখতে হয় । এসব ব্যবস্থাপনা হাপাতাল ছাড়া অন্য  কোথাও সম্ভবপর নয় বলে একজন প্রিম্যাচিউরড বেবিকে হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ডাক্তার ও নার্সের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়।

(২) বাড়িতে আনার পূর্বের সতর্কতা:

প্রিম্যাচিউরড বেবি যদি হাসপাতালে স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, তখনই তাকে হাসপাতাল হতে বাড়িতে নিয়ে আসার কথা ভাবতে পারেন। বাড়িতে আনার আগে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:

§  শিশু কি ইনকিউবেটরের বাইরে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছে কিনা?

§  ইনকিউবেটরের বাইরে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকছে কিনা?

§  বেবি কি টিউবের পরিবর্তে বোতলে কিংবা স্বাভাবিকভাবে মায়ের দুধ পান করতে পারছে কিনা?

§  শিশুর ওজন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা?

এসব বিষয়ে  নিশ্চিত হলেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে শিশুকে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেন। অধিকাংশ প্রিম্যাচিউরড বেবি ২-৪ সপ্তাহের মধ্যেই  স্বাভাবিক অবস্থায় এসে পড়ে । শিশুকে যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেই বাসায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

(৩) বাড়ির পরিবেশে প্রিম্যাচিউরড নবজাতকের যত্ন

শিশুকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর মা বাবাসহ পরিবারের সবারই  দায়িত্ব বেড়ে যায় । শিশুর কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা সেদিকে পরিবারের সবাইকে সার্বক্ষণিক নজরে রাখতে হয় । স্বাভাবিক নবজাতক শিশুর চেয়ে প্রিম্যাচিউরড বেবির জীবন নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্য করার জন্য অতিরিক্ত কিছু ব্যবস্থাপনা করতেই হয়।

§  নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা :

অপরিনত নবজাতক শিশুর দেহ সবসময়  উষ্ণ, শুষ্ক রাখতে হবে।  তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে শিশুর জন্য হালকা গরম গ্যাঞ্জি, নরম স্লিপিং স্যুট বা স্লিপিং ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে ।  পরিবেশের ঠান্ডা ও উষ্ণতার উপর নির্ভর করে শিশুর উপযুক্ত জামা কাপড়ের ব্যবস্থা করতে হবে । শিশুর তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য পরিস্কার তোয়ালে কুসুম কুসুম গরম জলে ভিজিয়ে এবং পরবর্তীতে তোয়ালে থেকে পানি ঝরিয়ে শিশুর সারা শরীর মুছে দিলে সে আরাম পাবে ।  ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুছার পর অবশ্যই  শিশুর শরীর শুকনো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে পরিস্কার জামা কাপড় পড়িয়ে দিতে হবে। কোন অবস্থায় শিশুর শরীর খালি রাখা যাবে না।  তা না হলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। গরমকালে কিছুক্ষণ পর পর কাপড়, শিশুর বিছানা পাল্টিয়ে দেয়া উচিত। এতে শিশু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। শীতকালে গরম জামা কাপড় বা পরিস্কার নরম তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে রাখলে, মায়ের বুকে শিশু জড়িয়ে থাকলে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে এবং ঠান্ডা লাগার ভয় থাকবে না।

§  নবজাতকের জন্য পুষ্টিকর খাবার

শিশুকে পর্যাপ্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত।  মায়ের দুধে যথেষ্ট পরিমান পুষ্টি গুণাগুন আছে যা শিশুর বেড়ে উঠার জন্য খুবই দরকার।  শিশু স্বাভাবিক অবস্থায় না আসা পর্যন্ত অপরিনত নবজাতক শিশুর মায়ের বুকের দুধ সহজে বন্ধ করা উচিত নয়। স্বাভাবিক নবজাতকের চেয়ে  অপরিণত নবজাতককে বেশিদিন মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত। এত শিশু নানা সংক্রমণের হাত থেকে যেমন রক্ষা পায় , তেমনি সবধরণের পুষ্টি গুণ সে মায়ের দুধ থেকে পেয়ে থাকে। এছাড়া তাকে তাজা ফলের রস, পানি খাওয়ানো যেতে পারে।

§  শিশুর যথাযথ ঘুমের ব্যবস্থা করা :

শিশু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, রাতে শিশু যে পরিমান ঘুমানোর কথা তার চেয়ে কম ঘুমাচ্ছে এবং রাতে বেশী কান্না করছে। ক্ষিধের কারণেও অনেকসময় এটি হয়ে থাকে। নবজাতক অপরিণত শিশুর প্রথম মাসে ঘন ঘন খাবারের প্রয়োজন হয়। শিশুর খাবারের যথাযথ ব্যবস্থা করা এবং রাতে শিশুর নিরাপদে, নিরুপদ্রবে ঘুমাতে সাহায্য করার জন্য  ঘরের পরিবেশ শান্ত রাখা , ঘরে কম আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

§  সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম :

সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম কি কারণে হয় তা এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সাধারণত শিশুর প্রথম ছয়মাস এধরনের উপসর্গে ভুগতে পারে। অনেক হেলদি বেবিও এধরণের সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। প্রিম্যাচিউরড বেবির ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরো বেশি। কিছু গাইডলাইন অনুসরণ করলে এই ঝুঁকি থেকে শিশুকে সহজে রক্ষা করা যায়।

-          শিশু উপুড় হয়ে যাতে না ঘুমায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।

-          ঘরে কেউ যেন ধুমপান না করে

-          শিশুর গায়ের কম্বল বা অন্য কাপড় যাতে তার মুখে না এসে পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখা

-          শিশুকে জড়িয়ে ধরে মা বাবা কেউ যেন বিছানায় বা সোফায় ঘুমিয়ে না পড়ে।

-          ঘরের তাপমাত্রা ১৬-২০ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে চেষ্টা করা

-          শিশুর আশেপাশে উনুন, হীটার  এ জাতীয় কিছু যেন না থাকে।

-          শিশুর সামনে এলকোহল, ড্রাগ জাতীয় কোন পদার্থ সেবন না করা।

§  শিশুকে কোলে নেয়ার পূর্বের সতর্কতা :

শিশুকে কোলে নেয়ার পূর্বে অবশ্যই অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে। অধিকাংশ রোগ জীবানু হাত দিয়ে বয়ে আসে।  প্রিম্যাচিউরড বেবির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেহেতু কম ,  তাই বাইরে থেকে কেউ এসে শিশুকে কোলে নিতে চাইলে  জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে তাপরপর শিশুকে কোলে নেয়া উচিত। এতে শিশু নানা সংক্রমণ হতে রক্ষা পাবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রিম্যাচিউরড বেবিকে অতিথিদের থেকে দূরে রাখা।

§  রুমের পরিবেশ

প্রিম্যাচিউরড বেবির সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তার রুমের পরিবেশ আদর্শ হওয়া উচিত। যথেষ্ট আলো বাতাস চলাচল করে এধরনের পরিবেশে শিশুকে রাখতে হবে। রুমের তাপমাত্রা  স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণত প্রিম্যাচিউরড বেবির রুম  মা-বাবার রুমের সাথেই হওয়া উচিত।   

§  মায়ের সান্নিধ্য:

প্রিম্যাচিউরড বেবিকে সবসময় মায়ের সান্নিধ্যে রাখা উচিত। সার্বক্ষণিক মায়ের বুকে রাখা গেলে শিশু উষ্ণ থাকে, পর্যাপ্ত বুকের দুধ পায় এবং শিশু নানা সংক্রমণ থেকেও রক্ষা পায়। মায়ের পরিচিত গন্ধ শিশু নিরাপদ মনে করে যা শিশু নিশ্চিন্তে এবং স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।

পরিশিষ্ট:

মা বাবার হাজারো স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নেয় একটি শিশু। কিন্তু সে যদি প্রিম্যাচিউরড বেবি হয় তাহলে মা বাবা সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকেন। অনেকেরই প্রশ্ন থাকে কেন একজন নবজাতক শিশু প্রিম্যাচিউরড হয়? কিভাবে তার যত্ন নিতে হবে? কিভাবে সে বেড়ে উঠবে? এসব চিন্তায় মা বাবা সারাক্ষণ উদ্বেগে থাকেন। এটি সত্যি যে প্রিম্যাচিউরড বেবির ক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে বেশি। তবে ডাক্তারের সঠিক পরামর্শ, পরিবারের সবার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং শিশুর যথাযথ পুষ্টির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে এধরনের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়। তবে যেসব কারনে একটি নবজাতক প্রিম্যাচিউরড হয় তা  পূর্বেই নিয়ন্ত্রন করার জন্য লক্ষ্য রাখা উচিত। আপনার নবজাতকের সুন্দর আগামী নিশ্চিত করার জন্য মা বাবা উভয়কেই এবিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। 

আমাদের কেয়ার লাইনে ফোন করে রবি থেকে বৃহস্পতিবার (সরকারী ছুটির দিন বাদে) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সুপারমম এর ডাক্তারদের সাথে সরাসরি পরামর্শ করতে পারেন মা ও শিশু বিষয়ক যেকোন সমস্যা নিয়ে আমাদের নাম্বার ০৮-০০০-৮৮৮-০০০