

গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচ মার্ক: কারণ, প্রতিরোধ ও যত্নের সঠিক উপায়
গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে একটি বিশেষ সময়, যা নতুন জীবনের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। তবে এই সময়ে শরীরে নানা পরিবর্তন দেখা যায়, যার মধ্যে স্ট্রেচ মার্ক (Stretch Marks) অন্যতম। গর্ভাবস্থায় ত্বক প্রসারিত হওয়ার কারণে স্ট্রেচ মার্ক হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এটি ত্বক প্রসারিত ও ফেটে যাওয়ার ফলে হয় এবং সাধারণত পেট, স্তন ও উরুতে দেখা যায়। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বংশগতি, দ্রুত ওজন বৃদ্ধি এবং হরমোনের পরিবর্তন, যা ত্বকের স্থিতিস্থাপকতাকে প্রভাবিত করে।১ যদিও এটি একটি সাধারণ ঘটনা, তবুও অনেক নারী এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য হলো গর্ভবতী মহিলাদের স্ট্রেচ মার্ক সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা এবং তা কমানোর কার্যকর উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা।
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচ মার্কের কারণ
ত্বকের প্রসারণ: গর্ভাবস্থায় দ্রুত ওজন বৃদ্ধি এবং পেটের আকার বাড়ার কারণে ত্বক প্রসারিত হয়। ত্বক যখন খুব দ্রুত প্রসারিত হয়, তখন কোলাজেন এবং ইলাস্টিন ফাইবারগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং ফেটে যায়। ফলে স্ট্রেচ মার্ক দেখা যায়।২
হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। বিশেষ করে, করটিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে ত্বকের কোলাজেন এবং ইলাস্টিন উৎপাদন কমে যায়।৩
জেনেটিক প্রভাব: যদি আপনার পরিবারের (মা, বোন) কারো স্ট্রেচ মার্ক হয়ে থাকে, তাহলে আপনারও স্ট্রেচ মার্ক হওয়ার ঝুঁকি বেশি।২
ত্বকের ধরন: কিছু বিশেষ ধরনের ত্বকে (যেমন, শুষ্ক ত্বক) স্ট্রেচ মার্ক হওয়ার প্রবণতা বেশি।
স্ট্রেচ মার্কের লক্ষণ
ত্বকে লম্বা দাগ: পেটে, স্তনে, উরু ও নিতম্বে গোলাপি, লাল বা বেগুনি রঙের লম্বা দাগ দেখা যায়। সাধারণত পেটের চারপাশে, স্তনের নিচে এবং উরুর ভেতরের দিকে এই দাগগুলো বেশি দেখা যায়।
চুলকানি: স্ট্রেচ মার্কের স্থানে হালকা চুলকানি হতে পারে, যা ত্বক প্রসারিত হওয়ার কারণে হয়ে থাকে।
দাগের গঠন: শুরুতে দাগগুলো সামান্য উঁচু ও মসৃণ থাকে, তবে পরে ধীরে ধীরে ফ্ল্যাট হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে দাগগুলোর রঙ হালকা হয়ে সাদা বা রূপালী বর্ণ ধারণ করে।
স্ট্রেচ মার্ক প্রতিরোধের উপায়
ত্বকের যত্ন: নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার, লোশন বা তেল ব্যবহার করে ত্বককে হাইড্রেটেড রাখা। দিনে অন্তত দুইবার ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। ভিটামিন ই তেল স্ট্রেচ মার্ক কমাতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায় এবং দাগ কমাতে সহায়তা করে।৪
খাদ্যাভ্যাস: ভিটামিন সি, ডি, ই, জিঙ্ক এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। এই উপাদানগুলো ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।৫ত্বককে হাইড্রেটেড রাখতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে (কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস) পানি পান করুন।৪
ওজন নিয়ন্ত্রণ: গর্ভাবস্থায় ধীরে ধীরে ওজন বাড়াতে চেষ্টা করুন, যাতে ত্বকের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। প্রতি সপ্তাহে ০.৫-১ কেজি ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক।
নিয়মিত ব্যায়াম: গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ ব্যায়াম, যেমন - হাঁটা বা যোগা করুন। এগুলো ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে।
স্ট্রেচ মার্ক কমানোর উপায়
সাধারণত বাচ্চা হওয়ার পর এই দাগগুলো নিজে থেকেই অনেকটা হালকা হয়ে আসে, তবে হয়তো কখনোই পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না।৬ বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরেও যদি স্ট্রেচ মার্ক হালকা না হয়, তাহলে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। তাছাড়া যেভাবে যত্ন নিতে পারেন তা নিয়ে নিচে লিখা হল-
ক্রিম ও লোশন: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। নিয়মিত ক্রিম ব্যাবহারে স্ট্রেচ মার্ক অনেক টা কমে যেতে পারে । সিকা (Centella Asiatica) সমৃদ্ধ ক্রিম স্ট্রেচ মার্ক কমাতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের ক্ষত নিরাময়ে এবং কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে।
তেল মালিশ: নারকেল তেল, জলপাই তেল, বাদাম তেল দিয়ে নিয়মিত মালিশ করলে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ে এবং স্ট্রেচ মার্ক হালকা হয়। দিনে দুইবার অন্তত ১০-১৫ মিনিট ধরে মালিশ করুন।
ডার্মাটোলজিক্যাল চিকিৎসা:(প্রসব -পরবর্তী সময়ের জন্য)
- লেজার থেরাপি: লেজার থেরাপি স্ট্রেচ মার্কের চেহারা উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায় এবং দাগ হালকা করে।
- মাইক্রোডার্মাব্রেশন: এই পদ্ধতিতে ত্বকের উপরের স্তর অপসারণ করা হয়, যা স্ট্রেচ মার্ক কমাতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের পুনর্গঠনে সহায়তা করে।
প্রাকৃতিক প্রতিকার:
- অ্যালোভেরা: অ্যালোভেরা জেল ত্বকের প্রদাহ কমায় এবং স্ট্রেচ মার্ক হালকা করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন স্ট্রেচ মার্কের ওপর অ্যালোভেরা জেল লাগান এবং কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন।
- ডিমের সাদা অংশ: ডিমের সাদা অংশে প্রোটিন থাকে, যা ত্বকের কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে। ডিমের সাদা অংশ ফেটিয়ে স্ট্রেচ মার্কের ওপর লাগান এবং ২০-২৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
উপসংহার
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচ মার্ক একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং এর জন্য হতাশ হওয়ার কিছু নেই। প্রায় সব মহিলার শরীরেই গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচ মার্ক দেখা যায়।
সঠিক যত্ন ও জীবনযাত্রার মাধ্যমে স্ট্রেচ মার্ক কমানো বা প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিজের প্রতি সদয় হোন এবং গর্ভাবস্থার এই সুন্দর সময়টি উপভোগ করুন। মনে রাখবেন, প্রতিটি মায়ের শরীর সুন্দর এবং এই স্ট্রেচ মার্কগুলো মাতৃত্বের প্রতীক।
তথ্য সুত্র
১. Brennan, M., Young, G., & Devane, D. (2012). Topical preparations for preventing stretch marks in pregnancy. Cochrane Database of Systematic Reviews, 2012(11), CD000066.
২. What to Expect. (n.d.). Stretch marks during pregnancy: Symptoms and solutions. What to Expect. Retrieved from https://www.whattoexpect.com/pregnancy/symptoms-and-solutions/stretch-marks.aspx#:~:text=hips%20or%20breasts.-,What%20causes%20stretch%20marks%20during%20pregnancy?,is%20to%20leave%20a%20mark
৩. NHS. (n.d.). Stretch marks in pregnancy. NHS. Retrieved from https://www.nhs.uk/pregnancy/related-conditions/common-symptoms/stretch-marks/#:~:text=Stretch%20marks%20on%20light%20brown,stretched%20and%20broken%20in%20places.
৪. Ascensus Health. (n.d.). Here's how to prevent stretch marks during pregnancy. Ascensus Health. Retrieved from https://ascensushealth.com.sg/blog/heres-how-to-prevent-stretch-marks-during-pregnancy/#:~:text=It%20is%20most%20effective%20to,the%20risk%20of%20stretch%20marks.
৫. Cleveland Clinic. (n.d.). Stretch marks. Cleveland Clinic. Retrieved from https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/10785-stretch-marks
৬. American College of Obstetricians and Gynecologists. “Skin Conditions During Pregnancy.” ACOG, https://www.acog.org/womens-health/faqs/skin-conditions-during-pregnancy.