

গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের গুরুত্ব: মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য পুষ্টি
গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের শরীরের ভেতরে যে জীবনের নতুন পথ চলা শুরু হয়, তা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এই সময়ে শিশুর শারীরিক, মানসিক এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ, পাশাপাশি মায়ের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান। এর মধ্যে প্রোটিন এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রোটিন শুধু মায়ের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে না, বরং শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ, পেশী গঠন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতেও সহায়ক। তাই গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের চাহিদা বেড়ে যায় এবং এটি গর্ভবতী মায়ের খাদ্যতালিকায় একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পরিগণিত হয়। গর্ভাবস্থায় সঠিক পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ শিশুর সুস্থ জন্ম এবং ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।১
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের গুরুত্ব:
১. শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ:
প্রোটিন শিশুর মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র এবং পেশী গঠনের জন্য অপরিহার্য। এটি শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি এবং তাদের মানসিক উন্নতি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে, যা ভবিষ্যতে তাদের সঠিক শিখন ক্ষমতা এবং মানসিক বিকাশে সহায়ক।
২. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন এবং বৃদ্ধি:
প্রোটিন শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠনে সহায়ক। এটি কোষের বৃদ্ধি, বিভাজন এবং পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা শিশুর শরীরের সকল অঙ্গের সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করে।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা:
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের সঠিক পরিমাণ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনে সহায়ক। এটি মায়ের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে এবং শিশুকে সংক্রমণ এবং অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়ক। এটি গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যগত সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
৪. হরমোন এবং এনজাইমের উৎপাদন:
প্রোটিন হরমোন এবং এনজাইমের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম যেমন বিপাক এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
৫. মায়ের শারীরিক সুস্থতা:
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরের শারীরিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়, এবং প্রোটিন তাকে শক্তি এবং পুষ্টি সরবরাহ করতে সাহায্য করে। এটি মায়ের পেশী গঠন এবং কোষের পুনর্গঠনেও সহায়ক, যা তাকে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখে এবং গর্ভকালীন বিভিন্ন শারীরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করে।
তাছাড়া প্রোটিনের অভাব গর্ভাবস্থায় মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এটি শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এবং মা কিংবা শিশুর জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় সঠিক পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের উৎস এবং সঠিক পরিমাণ
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের চাহিদা বেড়ে যায়, এবং এটি মায়ের এবং শিশুর সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করতে উপযুক্ত খাদ্য থেকে প্রাপ্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।২ গর্ভাবস্থার প্রারম্ভিক পর্যায়ে গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিন গড়ে ৭৯ গ্রাম প্রোটিন এবং গর্ভাবস্থার শেষের দিকে ১০৮ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত।৩ তবে এটি মায়ের শারীরিক অবস্থা এবং গর্ভাবস্থার প্রগতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।
১. প্রোটিনের প্রধান উৎস:৪
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য কিছু প্রধান প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য রয়েছে। এই খাদ্যগুলি সহজলভ্য এবং পুষ্টিকর হওয়ায় গর্ভবতী মায়ের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:
- মাছ: প্রতিটি মাছের মধ্যে প্রোটিন থাকে, তবে মাছের ধরন অনুযায়ী প্রোটিনের পরিমাণ কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত মিষ্টি পানির মাছ এবং সামুদ্রিক মাছ উভয়েই প্রোটিন সমৃদ্ধ।
- মাংস: গরু, মুরগি, খাসি বা অন্যান্য মাংস প্রোটিনের ভালো উৎস।
- ডিম: এটি সস্তা, সহজলভ্য প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস।
- ডাল: মসুর, ছোলা, মুগ ডাল ইত্যাদি প্রোটিনের বেশ ভালো প্রোটিন উৎস।
- সয়াবিন: ভেগান ব্যাক্তিদের জন্য এটি বেশ ভালো প্রোটিনসমৃদ্ধ বিকল্প হতে পারে।
- দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য: দুধ, দই, পনির যা ক্যালসিয়াম এবং প্রোটিন দুইটিরই ভাল উৎস।
২. সঠিক প্রোটিন পরিমাণ:
গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন প্রোটিনের চাহিদা মায়ের ওজন, শারীরিক কার্যকলাপ এবং গর্ভাবস্থার স্তরের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ শিশুর বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়। তাই একটি সুস্থ গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করতে প্রোটিনের যথাযথ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. ভেজিটেরিয়ান এবং ভেগানদের জন্য প্রোটিন:
যদি কোনো গর্ভবতী মা ভেজিটেরিয়ান বা ভেগান হন তাহলে তাদের প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডাল, সয়া, বাদাম, শস্য, এবং বীজ ব্যবহার করা উচিত। এদের মধ্যে সঠিক পরিমাণে প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা গর্ভাবস্থায় মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়।
গর্ভাবস্থায় প্রোটিন গ্রহণে কিছু সতর্কতা ও নির্দেশনা
গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টি গ্রহণ অপরিহার্য, তবে প্রোটিনের অতিরিক্ত বা অপর্যাপ্ত গ্রহণ থেকেও বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। তাই প্রোটিন গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা এবং উপদেশ মাথায় রাখা উচিত:
১. প্রোটিনের অতিরিক্ত গ্রহণ:
যদিও প্রোটিন গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণও কিছু সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত প্রোটিনের কারণে গর্ভবতী মায়ের কিডনিতে অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণে মায়ের ডিহাইড্রেশনও হতে পারে, কারণ শরীর অতিরিক্ত প্রোটিন বিপাক করার জন্য অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে।
২. প্রাকৃতিক উৎসের প্রোটিনের প্রতি গুরুত্ব দিন:
প্রাকৃতিক এবং পুষ্টিকর উৎস থেকে প্রোটিন গ্রহণ করা সবচেয়ে ভালো। প্রক্রিয়াজাত এবং অতিরিক্ত চিনি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার থেকে প্রোটিন গ্রহণ পরিহার করা উচিত। সয়া, ডাল, মাছ, মাংস এবং ডিমের মতো প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রোটিন গ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত।
৩. সুন্দরভাবে রান্না করা খাবার খাওয়া:
গর্ভাবস্থায় মায়ের এবং শিশুর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত মাছ, মাংস বা ডিমের মতো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারগুলো সঠিকভাবে রান্না করা উচিত। কারণ অর্ধ-রান্না বা অপর্যাপ্তভাবে রান্না করা খাবারগুলি স্যালমোনেলা বা লিস্টেরিয়া জাতীয় জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে, যা গর্ভাবস্থায় মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
৪. বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন গ্রহণের চেষ্টা করুন:
প্রোটিনের বিভিন্ন উৎস যেমন মাছ, মাংস, ডাল, সয়া এবং অন্যান্য উদ্ভিদজাত প্রোটিন মিশ্রিত করে খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন। এতে পুষ্টির বৈচিত্র্য বজায় থাকে এবং আপনার শরীরের প্রয়োজনীয় সকল অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ হয়।
৫. পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের সঠিক পরিমাণ এবং উৎস সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকলে পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। তারা আপনাকে আপনার শরীরের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান গ্রহণে সহায়ক পরামর্শ দিতে পারেন। এখানে গর্ভাবস্থায় প্রোটিন গ্রহণের সময় স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং কিছু সাধারণ ভুল থেকে সাবধান থাকার উপদেশ দিতে পারেন, যাতে মা এবং শিশু উভয়েরই সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না, কারণ এটি মা এবং শিশুর সুস্থতা এবং বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।৩ সঠিক পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ শিশুর শারীরিক গঠন, মস্তিষ্কের বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মায়ের শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে সহায়ক। তবে, প্রোটিনের অভাব কিংবা অতিরিক্ত গ্রহণ উভয়ই স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই সঠিক পরিমাণে এবং স্বাস্থ্যকর উৎস থেকে প্রোটিন গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি, গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের সঠিক পরিমাণ এবং উৎস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ এবং তা খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা মা এবং শিশুর জন্য জীবনযাত্রার গুণমান বৃদ্ধি এবং সুস্থতা নিশ্চিত করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তথ্য সুত্র
- Switkowski, K. M., Jacques, P. F., Must, A., Kleinman, K. P., Gillman, M. W., & Oken, E. (2016). Maternal protein intake during pregnancy and linear growth in the offspring. The American Journal of Clinical Nutrition, 104(4).
- Kalhan, S. C. (2000). Protein metabolism in pregnancy. American Journal of Clinical Nutrition, 71(5).
- Dubois, S., Coulombe, C., Pencharz, P., Pinsonneault, O., & Duquette, M. P. (1997). Ability of the Higgins Nutrition Intervention Program to improve adolescent pregnancy outcome. Journal of the American Dietetic Association, 97(8), 871-878.
- Williamson, C. S. (2006). Nutrition in pregnancy. Nutrition Bulletin, 31(1), 28-59.
- King, J. C. (2000). Physiology of pregnancy and nutrient metabolism. American Journal of Clinical Nutrition, 71(5).