

গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ: সুস্থ মা ও শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় টিপস
গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে স্ট্রেস বা চাপ অনুভব করা স্বাভাবিক। তবে অতিরিক্ত স্ট্রেস মা ও গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেসের লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেসের লক্ষণগুলো একেকজনের জন্য একেক রকম হতে পারে, তবে সাধারণত নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে: ১
- অতিরিক্ত চিন্তা বা চাপ অনুভব হওয়া।
- ঘুমের সমস্যা হওয়া
- মাথা ব্যথা ।
- হার্ট বেশি দ্রুত ধপধপ করা।
- শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠা।
- মন খারাপ বা ভয় ভয় মনে হওয়া।
- রাগ বা অস্থিরতা বাড়া।
- বেশি বা কম খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেওয়া।
- অস্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ বা খাওয়া শুরু করা।
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেসের কারণ
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেসের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যা মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।
প্রথমত, শারীরিক পরিবর্তন যেমন ওজন বৃদ্ধি, হরমোনের পরিবর্তন ও ক্লান্তি স্ট্রেস সৃষ্টি করতে পারে। গর্ভাবস্থায় শরীরে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যা মায়ের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হতে পারে এবং এতে মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক চিন্তা, বিশেষ করে শিশুর ভবিষ্যত ও চিকিৎসা খরচ নিয়ে উদ্বেগ স্ট্রেস বাড়াতে পারে। গর্ভাবস্থায় এবং শিশুর জন্মের পরের খরচ সম্পর্কে চিন্তা মায়ের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। আর্থিক অনিশ্চয়তা বা ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা স্ট্রেসের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয়ত, পারিবারিক চাপ, যেমন পরিবারের সদস্যদের অতিরিক্ত প্রত্যাশা বা সমর্থনের অভাব, গর্ভবতী মায়ের মানসিক চাপ বাড়ায়। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে অতিরিক্ত প্রত্যাশা বা সমর্থনের অভাব মায়ের জন্য মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। পারিবারিক পরিবেশ যদি সহায়ক না হয়, তাহলে মায়ের মানসিক চাপ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
চতুর্থত, কর্মক্ষেত্রে চাপ, যেমন কাজের চাপ বা মাতৃত্বকালীন ছুটির অনিশ্চয়তা, স্ট্রেসের কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় কাজের চাপ বা কর্মক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটির অনিশ্চয়তা মায়ের মানসিক চাপ বাড়াতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সমর্থনের অভাব বা কাজের চাপ মায়ের জন্য মানসিক চাপের একটি বড় উৎস হতে পারে।
পঞ্চমত, গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগও মায়ের মানসিক চাপ বাড়াতে পারে। গর্ভাবস্থায় শিশুর সুস্থতা নিয়ে চিন্তা মায়ের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। শিশুর বিকাশ ও স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা মায়ের জন্য একটি বড় মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই সকল কারণগুলো গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপ বাড়াতে পারে, যা মা ও গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্ট্রেসের প্রভাব
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেসের প্রভাব মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। মায়ের ক্ষেত্রে স্ট্রেস উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, বিষণ্ণতা ও প্রি-একলাম্পসিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে, গর্ভস্থ শিশুর জন্য স্ট্রেস প্রিম্যাচিউর বার্থ, কম ওজন বা বিকাশগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। গর্ভাবস্থায় বৃদ্ধি পাওয়া চাপ ও উদ্বেগ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করে।২ তাই গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের উপায়
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ। সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত, বিশেষ করে ফল, শাকসবজি ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত যাতে শরীর হাইড্রেটেড থাকে। নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত, যেমন হালকা যোগব্যায়াম, হাঁটা বা সাঁতার। ব্যায়াম শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়ের জন্যই উপকারী।৫
পর্যাপ্ত বিশ্রাম
পর্যাপ্ত বিশ্রাম স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। দিনে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত এবং রাতে ভালো ঘুমের জন্য একটি নিয়মিত রুটিন মেনে চলা উচিত। রিলাক্সেশন টেকনিক যেমন মেডিটেশন, ডিপ ব্রিদিং বা ইয়োগা অনুশীলন করা উচিত। এই পদ্ধতিগুলো মানসিক চাপ কমাতে কার্যকরী।৬
মানসিক স্বাস্থ্য যত্ন
মানসিক স্বাস্থ্য যত্ন নেওয়া স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার বা বন্ধুদের সাথে অনুভূতি শেয়ার করা উচিত এবং তাদের কাছ থেকে সমর্থন নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ইতিবাচক চিন্তা করা উচিত এবং শিশুর আগমনের জন্য আনন্দিত থাকা উচিত।৭
সময় ব্যবস্থাপনা
সময় ব্যবস্থাপনা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। প্রিয় কাজ যেমন বই পড়া, গান শোনা বা শখের কাজে সময় দেওয়া উচিত। অপ্রয়োজনীয় কাজ এড়িয়ে চলা উচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য একটি তালিকা তৈরি করা উচিত। এটি মানসিক চাপমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।৬
পারিবারিক সমর্থন
পারিবারিক সমর্থন গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস কমাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নেওয়া উচিত এবং তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত। সঙ্গী বা পরিবারের সাথে গর্ভাবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো শেয়ার করা উচিত এবং তাদের সমর্থন নেওয়া উচিত।৫
শিক্ষা ও প্রস্তুতি
গর্ভাবস্থা সম্পর্কে জানা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। বই, ব্লগ বা ক্লাসের মাধ্যমে গর্ভাবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। প্রসব প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা উচিত এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা উচিত। এটি আত্মবিশ্বাসী ও চাপমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।৩
সতর্কতা
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু সতর্কতা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। নিচে এই সতর্কতাগুলো সুন্দরভাবে বুলেট পয়েন্ট আকারে উপস্থাপন করা হলো:
- অতিরিক্ত স্ট্রেস হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত স্ট্রেস মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই স্ট্রেসের মাত্রা বেড়ে গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।৩ - ধূমপান, মদ্যপান বা ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা উচিত।
ধূমপান, মদ্যপান বা ক্যাফেইন গ্রহণ স্ট্রেস বাড়াতে পারে এবং গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এগুলো সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা উচিত।৬ - কোনো ওষুধ সেবনের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় কিছু ওষুধ ক্ষতিকর হতে পারে। তাই কোনো ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।৩
এই সতর্কতাগুলো মেনে চললে গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে এবং মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
উপসংহার
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, মানসিক যত্ন ও পারিবারিক সমর্থনের মাধ্যমে স্ট্রেস কমানো সম্ভব। একজন সুস্থ মা-ই একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারেন। তাই নিজের যত্ন নেওয়া উচিত এবং গর্ভাবস্থাকে আনন্দময় করে তোলা উচিত। এই আর্টিকেলটি গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করে। এটি অনুসরণ করে গর্ভবতী মায়েরা তাদের স্ট্রেস কমাতে পারেন এবং সুস্থ ও সুখী গর্ভাবস্থা উপভোগ করতে পারেন।
তথ্য সুত্র
১∙ How much stress is too much during pregnancy? Medical News Today https://www.medicalnewstoday.com/articles/how-much-stress-is-too-much-when-pregnant#how-much-is-too-much
২∙ Stress during pregnancy affects both mother and baby, BOLD https://boldscience.org/stress-during-pregnancy-affects-both-mother-and-baby/?gad_source=1&gad_campaignid=22391056008&gbraid=0AAAAADQBVfsrHqA_cm9xomy9zQQpIk0qD&gclid=CjwKCAjwisnGBhAXEiwA0zEOR2n6jdw5fZjQB8HKRKC_-SNqdjjvi4zP9vl-60-jVfBsMYLjV3QWzhoCKKQQAvD_BwE
৩∙ Stress During Pregnancy, American Pregnancy Association https://americanpregnancy.org/healthy-pregnancy/pregnancy-health-wellness/stress-during-pregnancy/
৪∙ Perinatal mental health, WHO https://www.who.int/teams/mental-health-and-substance-use/promotion-prevention/maternal-mental-health
৫∙ Depression during pregnancy: You're not alone, By Mayo Clinic Staff https://www.mayoclinic.org/healthy-lifestyle/pregnancy-week-by-week/in-depth/depression-during-pregnancy/art-20237875
৬∙ Mental health in pregnancy, NHS https://www.nhs.uk/pregnancy/keeping-well/mental-health/
৭∙ American Psychological Association. (2023, November 16). High levels of maternal stress during pregnancy linked to children’s behavior problems [Press release]. https://www.apa.org/news/press/releases/2023/11/maternal-stress-behavior-problems