
নবজাতক ও মায়ের প্রতি বাবার দায়িত্ব
একটি নতুন শিশুর আগমন পুরো পরিবারের জীবনে অনেক বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটি আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও আনতে পারে এবং পরিবারে নতুন গতিশীলতা তৈরি করে। বেশিরভাগ সময় মায়ের দায়িত্ব পালনের দিকেই সকলের মনোযোগ বেশি থাকে এবং তা মুখ্য বলেই ধরে নেওয়া হয়, তবে বাবার দায়িত্ব এবং অংশগ্রহণও সমান ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। একজন বাবার ভূমিকা শুধু মাকে সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিশুর সাথে একটি শক্তিশালী বন্ধন গড়ে তুলতেও বাবার ভূমিকা রয়েছে। শিশুর জন্ম নেওয়ার পরের এ সময়টি বেশ পরিবর্তনের ও নতুন দায়িত্বের, তাই সবকিছু এক সঙ্গে সামলে নেওয়া ও পরিবারের জন্য সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য বাবার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
মায়ের জন্য মানসিক সমর্থন
প্রসবের পর মা শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্তি ও অবসাদের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময়টি মায়ের জন্য বেশ কঠিন হতে পারে। এ সময়ে একজন বাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো মা-কে মানসিকভাবে ভাল রাখা। তার আশ্বাস, ধৈর্য্য ও বোঝাপড়া এসময় নতুন মায়ের খুবই কাজে আসে। তার মনোভাব শোনা, উৎসাহ দেওয়া এবং পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে কাজ ভাগ করে দেওয়ার মাধ্যমে একজন বাবা এই সময় মায়ের জন্য একটু সহজ করে দিতে পারেন।
বিশেষজ্ঞ জন গটম্যান বলেছেন, “একজন বাবার মানসিক সমর্থন মা’র স্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি, যা শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”১ এই সময়টা ঠিকঠাক কেটে গেলে তা মা ও নবজাতকের জন্য খুবই ভালো।
সক্রিয়ভাবে শিশুর যত্ন নেওয়া
যেসব বাবা সক্রিয়ভাবে শিশুদের যত্নে অংশ নেন, তারা দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া ও একসঙ্গে কাজ করার অনুভূতি তৈরি করেন। এর মধ্যে থাকতে পারে ডায়াপার বদলানো, শিশুকে গোসল করানো, খাওয়ানো (যদি বোতলে খাওয়ানো হয়) এবং শিশুকে শান্ত করে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করা। এর ফলে মায়ের দায়িত্ব অনেকটা কমে যায় এবং বাবা শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ও তার প্যারেন্টিং দক্ষতার ওপর আস্থা বাড়াতে পারেন। মার্কিন পেডিয়াট্রিক অ্যাকাডেমির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, “যেসকল বাবা ব্যক্তিগতভাবে শিশুর যত্ন নেন, তারা তাদের শিশুর সঙ্গে তুলনামূলক গভীর আবেগের সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন এবং নিজেদের প্যারেন্টিং রোলে বেশি সন্তুষ্টি পান।”২
নবজাতকের সঙ্গে বন্ধন গড়ে তোলা
শিশুর বিকাশে বাবাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এই বন্ধন তৈরি খুব দ্রুত শুরু হয়। স্কিন-টু-স্কিন স্পর্শ, শিশুদের সঙ্গে কথা বলা বা গান গাওয়া এবং একসঙ্গে সুন্দর সময় কাটানো এই বন্ধনটাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই সম্পর্ক শিশুর মধ্যে নিরাপত্তা ও আস্থা তৈরি করে, যা একটি সুস্থ ও হাসিখুশি প্যারেন্ট-চাইল্ড সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে। শিশু মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. কাইল প্রুইট বলেন, “বাবারা শিশুর সাথে অন্য ধরনের সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা মা-বাবার সম্পর্কের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক হলেও শিশুর মানসিক ও জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক।”৩
একটি স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা
একজন বাবা থাকলে, মা ও শিশুর জন্য বাড়িতে একটি শান্ত ও যত্নশীল পরিবেশ তৈরি হয়। তিনি ঘর সামলানো, বাইরে কাজের জন্য যাওয়া ও পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সমন্বয় করার কাজ করেন, যাতে মা তার নিজের সুস্থতা ও শিশুর যত্নের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। এই স্থিতিশীলতা পুরো পরিবারের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ। ড. সারাহ অ্যালেন, একজন পারিবারিক থেরাপিস্ট, বলেন, “ঘর সামলানোর জন্য বাবার সক্রিয় ভূমিকা সরাসরি মা ও শিশুর সাথে তার সম্পর্ক এবং পরিবারের সম্পর্ক মজবুত করতে সাহায্য করে।”৪
মাকে সুস্থ রাখতে উৎসাহ দেওয়া
মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখাটাও একজন বাবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মায়ের জন্য প্রয়োজন: পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া, ভালো করে খাওয়া এবং প্রয়োজন হলে সহায়তা গ্রহণের জন্য তাকে উৎসাহিত করা। এই বিষয়গুলো ক্লান্তি কমাতে ও ভবিষ্যতে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে। মায়ের সুস্থতার জন্য যত বেশি যত্ন নেওয়া যাবে, শিশুর বিকাশ ও স্বাস্থ্যের উন্নতি তত বেশি হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, “যখন বাবা সক্রিয়ভাবে মায়ের শারীরিক ও মানসিক ক্ষয়পূরণে সাহায্য করেন, তখন ডিপ্রেশনের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।”৫
পরিবারের জন্য সহযোগিতা ও সমর্থন
বাবারা অনেক সময় পরিবারের প্রধান দায়িত্বশীল ও সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের কাজের মধ্যে থাকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে যোগাযোগ রাখা, সময়সূচি পরিকল্পনা করা এবং শিশুর যত্ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। এই সক্রিয় ও প্রাণবন্ত উদ্যোগ নিশ্চিত করে যে, পরিবারের সব প্রয়োজন পূরণ হয় এবং সবাই নিরাপদ বোধ করে। ড. মাইকেল ল্যাম্ব বলেন, “পরিবারে যে সকল বাবা দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন, তারাই পরিবারের মধ্যে নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের বন্ধন তৈরি করতে পারেন।”৬
ভালো আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন
শুরু থেকেই বাবা-মারা তাদের সন্তানদের জন্য আদর্শ হিসেবে কাজ করেন। ভালোবাসা, ধৈর্য্য ও দায়িত্বশীলতা দেখিয়ে তারা শিশুকে সঠিক পথ দেখান। এই ইতিবাচক দৃষ্টান্ত শিশুদের অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং পরিবারের ভিতরের বিষয়গুলো বোঝার জন্য শক্ত ভিত্তি তৈরি করে। শিশু বিকাশের বিশেষজ্ঞ ড.পার্ক বলেন, "শিশুরা তাদের বাবাদের আচরণ দেখে সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং দায়িত্ববোধ শিখে থাকে।"৭
নিয়মিত শিখতে থাকা
প্যারেন্টিং মানে হলো জীবনের একটা ধারাবাহিক শেখার প্রক্রিয়া। বাবাদের উচিত এই ব্যাপারে উৎসাহী থাকা। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, পরামর্শ নেওয়া, আর নতুন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মন খুলে ভাবা- এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং আরও দক্ষ বাবা হতে সাহায্য করে। সমাজবিজ্ঞানী ডা. পল আমাটো বলেন, “কৌতুহল ও শেখার আগ্রহের সাথে প্যারেন্টিং করলে, পরিবারের সাথে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।”
যা জানা প্রয়োজন
নতুন শিশু ও তার মায়ের জীবনে একজন বাবার ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক সহায়তা, যত্ন নেওয়া এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও ভালোবাসাময় পরিবেশ তৈরি করে বাবা পরিবারে সুখ, শান্তি এবং সুস্থতা নিয়ে আসেন। তার অংশগ্রহণ শুধু শিশুর সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর করে তোলে না, বরং মাকে সাহস যোগায়। এই সম্পর্কের ভিত্তি হলো প্রেম, বিশ্বাস এবং সহযোগিতা-যা পুরো পরিবারের শক্তি অর্জনে সহায়ক।
তথ্য সুত্র
1. Gottman, J. (2015). The Role of Emotional Support in Parenting. Journal of Marital and Family Therapy.
2. American Academy of Pediatrics (AAP). (2018). The Role of Fathers in Infant Caregiving. Pediatrics Journal.
3. Pruett, K. (2000). Fatherneed: Why Father Care is as Essential as Mother Care for Your Child. Free Press.
4. Allen, S. (2020). Family Stability and Postpartum Recovery. Journal of Family Therapy.
5. Field, T., et al. (2017). Father Involvement and Postpartum Depression. Journal of Family Psychology.
6. Lamb, M. (2019). The Role of the Father in Child Development. Developmental Psychology.
7. Parker. (2013). Fatherhood and Child Development. Child Development Perspectives.
8. Amato, P. (2016). Fatherhood and Family Dynamics. Family Relations.