নতুন মায়ের খাদ্য ও পুষ্টি

নতুন মায়ের খাদ্য ও পুষ্টি
যে অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করে একজন মা তার
সন্তান কে পৃথিবীর আলো দেখান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও
একজন মায়ের ত্যাগ স্বীকারের প্রহর গোণার দিন বাড়ে বৈ কমে না। সবাই জানি যে জন্মের
পর থেকেই শিশুর যত্ন নিতে হয়। কিন্তু জানেন কি যে মায়ের সঠিক যত্ন ও পুষ্টির উপরই
নির্ভর করে সুস্থ সবল শিশুর যত্ন ও বেড়ে ওঠা। সন্তান জন্মগ্রহণের পর প্রত্যেক নতুন মায়ের জন্য যথেষ্ট পরিচর্যা প্রয়োজন।
শিশু জন্মের পর সবার মনোযোগ বেশিরভাগ সময় শিশুটির উপরই থাকে। নতুন মায়ের
স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে ভুলেই যায় সবাই। অথচ এই সময় মায়েদের
প্রয়োজন হয় বাড়তি যত্নের। নতুন মাকে সন্তান প্রসবের শারীরিক দূর্বলতা কাটিয়ে সুস্থ
হয়ে উঠতে প্রয়োজন পড়ে পুষ্টিকর খাবারের। এছাড়া নবজাতক শিশু প্রথম কয়েকমাস মায়ের
বুকের দুধের উপর নির্ভরশীল থাকে। তার দৈহিক
পুষ্টি সম্পূর্ণভাবে এসময় মায়ের
দুধের উপর নির্ভর করে।
নতুন মায়ের বাড়তি পুষ্টি কেন দরকার হয়
একজন
নতুন মায়ের অন্যান্য নারীদের তুলনায় বেশি খেতে হয়। এমনকি একজন গর্ভবতী নারীর
তুলনায়ও তার খাবারের চাহিদা বেশি থাকে। নবজাতকের মায়ের নিজের দেহের ক্ষয়পূরণ এবং
পাশাপাশি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে তার এই অতিরিক্ত খাবারের দরকার।
স্বাভাবিকের
চেয়ে নবজাতক মায়ের অতিরিক্ত ৭৫০ ক্যালরির সাথে প্রায় ২৬ গ্রাম বেশি আমিষের প্রয়োজন
হয়। এজন্য নবজাতকের মাকে প্রতিদিন
প্রোটিন জাতীয় খাবার যথা-মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে। সিদ্ধ
খাবার বেশী করে খেতে হবে। সাধারণত নবজাতকের মায়ের বুকে দৈনিক ২০-৩০ আউন্স
দুধ তৈরি হয়। ২ গ্রাম খাদ্য প্রোটিন থেকে ১ গ্রাম দুধের প্রোটিন তৈরি হয়। এটি তখনই
সম্ভব মায়েরা যদি দৈনিক ১০০ গ্রাম প্রোটিনের মধ্যে অর্ধেক বা দু-তৃতীয়াংশ প্রাণিজ
প্রোটিন যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি গ্রহণ করেন। প্রাণিজ প্রোটিন মায়ের
দুধের উৎকৃষ্ট উপাদান।
১. শর্করা জাতীয় খাবার:
নবজাতকের মায়ের
দেহে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং হৃত দৈহিক শক্তি ফিরে পেতে শর্করা জাতীয় খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
চাল, আটা, ময়দা,আলু, গুড়, চিনি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমানে কার্বোহেইড্রেট
পাওয়া যায়। মায়ের প্রয়োজন অনুসারে শর্করা জাতীয় খাবার মায়ের
এবং তার শিশুর শরিীরিক বিকাশে উল্লখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
২. প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার:
সব রকমের ডাল, শিমের বিচি, ছোট
মাছ, শুটকি, ডিম ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন আছে।আমিষ জাতীয় খাবার মায়ের
শরীরের ক্ষয় পূরণে সহায়তা করে এবং শিশুর শরীর গঠনে সাহায্য করে। ডিমের কুসুমে
ভিটামিন ডি , মিনারেল এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান আছে যা বাচ্চার হাড় মজবুত করে।
দিনে এক থেকে দুটি ডিম খাওয়া যেতে পারে।
৩. আঁশ যুক্ত খাদ্য:
উচ্চ আঁশযুক্ত
খাবার সহজে হজম হতে চায় না।
নতুন মায়েরা প্রায় সময় কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় ভুগে থাকেন। এজন্য বেশি পরিমানে
আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। কচুশাক, সজনে, কলার মোচা, ঢেঁড়স, ডাটা, বাঁধাকপি,
ফুলকপি, ওলকপি, শিম, পটল, কচু, বেগুন, বরবটি, মটরশুঁটি, কলমিশাক, পুদিনা পাতা, পুঁইশাক,
মূলাশাক, ডাটাশাক, লাউয়ের পাতা ও মিষ্টি
কুমড়ার শাকে প্রচুর আঁশ রয়েছে। এছাড়া জিরা পানি পান করতে পারেন। জিরা
ল্যাকটিনের পরিমান বৃদ্ধি করে এবং
খাবার হজমে সাহায্য করে।
৪.শাকসব্জি
যেকোন সবুজ শাক-সবজি নতুন মায়েদের জন্য উপকারী। শাক-সবজিতে
রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন। এর মধ্যে পালং শাক, কচু শাক, অন্যতম। এতে প্রচুর
পরিমাণে ভিটামিন এ, ফলিক অ্যাসিড থাকে, যা নতুন রক্ত কোষ তৈরি করে। যে সকল মায়েদের
শিশু জন্মদানের সময় রক্তপাত হয়ে থাকে তাদের জন্য পালং শাক খাওয়া অনেক প্রয়োজন।
৫.
ফলমূল
নবজাতক ও মায়ের
ভিটামিন ও পুষ্টির জন্য নানারকম ফল খাওয়া উচিত। ফল খেতে না চাইলে তাজা ফলের জুস
খাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন রকম দেশীয়
মৌসুমি ফলে প্রচুর ভিটামিন থাকে। সাধারণ দেশীয় ফল, যেমন- কলা, পেঁপে, পেয়ারা, বেল, আম, জাম, কাঁঠাল
প্রভৃতি ভিটামিন সমৃদ্ধ ফল।
৬. দুগ্ধ জাতীয় খাবার
দুধ এবং দুধ জাতীয় খাবারে প্রচুর
পরিমাণে প্রোটিন এবং স্নেহ জাতীয় পদার্থ রয়েছে। বিশেষ করে গরুর দুধে থাকে
প্রোটিন। প্রতিদিন দুই গ্লাস করে দুধ পান করুন। ক্যালসিয়াম, ভিটামিনসহ অনেকগুলো
পুষ্টির চাহিদা পূরণ করবে এক গ্লাস দুধ। এছাড়া দুধ শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য
করে।
৭.
ওমেগা ৩ ফ্যাট জাতীয় খাদ্য:
মায়ের শরীরের
ক্ষতি পুষিয়ে দিতে এবং শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে ওমেগা ৩ ফ্যাট জাতীয় খাদ্যের কোন
বিকল্প নেই। এছাড়া শিশুর দাঁত ও হাড় গঠনে ভুমকা রাখে। কাঠবাদাম, ছোট সামুদ্রিক
মাছ, মাগুর মাছ, মাছের তেল থেকে
প্রচুর পরিমানে ওমেগা ৩ ফ্যাট পাওয়া যায় যা প্রেগনেন্সির ধকল কাটিয়ে উঠতে নতুন
মাকে সাহায্য করে। কাঠ বাদাম নিয়মিত খাওয়া উচিত নতুন মায়েদের। কারন কাঠবাদামে
ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড ছাড়াও ভিটামিন ই ও প্রয়োজনীয় এসেন্সিয়াল অয়েল রয়েছে।
৮.
খনিজ লবন
ক্যালসিয়াম সর্বাধিক পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ
একটি খনিজ লবণ। ক্যালসিয়াম আমাদের হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত ও শক্তিশালী করে, ক্ষয়রোধ
করে এবং আর্থ্রারাইটিস, বাতজাতীয় রোগের সাথে লড়াই করে। নতুন মায়ের রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়া
দূর করার জন্য আয়রন প্রতিরোধের জন্য ক্যালসিয়ামের অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়াও আয়োডিন
গলগণ্ড, দুর্বলতা, স্তন ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে থাকে। মাছের তেল, বিভিন্ন
সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিন মিশ্রিত খাবার লবণ হতে খুব সহজেই আয়োডিন পাওয়া যায়। কডলিভার
অয়েলে আয়োডিন ছাড়াও আছে একটি মূল্যবান উপাদান ভিটামিন ‘এ’ যা অন্ধত্ব ও রাতকানা প্রতিরোধ
করে। এ ছাড়া আরো আছে ক্যালসিয়াম, যা শিশুদের হাড় ও দাঁত মজবুত করে।
৯. পানি:
পানিতে রয়েছে
প্রচুর পরিমানে খনিজ পদার্থ । সব খাদ্যে কমবেশি পানি থাকে।
খাদ্য গ্রহণ, পরিপাক ও শোষণ করতে পানির প্রয়োজন। পানি রক্ত তরল রাখে এবং মলমূত্রের
সাথে দূষিত পদার্থ দেহ থেকে বের করে দেয়। পানির অভাবে হজমে সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা
দেয়। নবজাতক মায়ের দুধ খাওয়ায় মাকে প্রচুর
পরিমানে পানি পান করতে হয়। সন্তানের জন্মের
পর অনেকসময় মায়ের পানিশূন্যতা
দেখো দেয়। ময়ের পানি শূন্যতা রোধে প্রচুর
পরিমানে পানি পান
করতে হয় নবজাতক সন্তানের মাকে।
১০. পানীয় ও ধুমপান:
নবজাতক মাকে
তার সন্তানের সুস্থতা এবং সন্তানের শরীরিক ও মানসিক বিকাশের কথা মাথায় রেখে
নানাধরনের এলকোহল জাতীয় পানীয় এবং ধুমপান অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
১১. যেসব খাদ্য বর্জনীয়
জাঙ্ক ফুড, মসলাযুক্ত খাবার, উচ্চ ক্যাফিনযুক্ত
পানীয়, অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাদ্য, সম্পৃক্ত চর্বি
নবজাতক মায়ের জন্য অবশ্যই বর্জনীয় । আংশিক রান্না করা খাবার নতুন মায়ের পক্ষে ভালো নয়। এতে তার
যেমন শারীরিক ক্ষতি করে তেমনি তার শিশুরও শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। কারন কম
রান্নাযুক্ত খাবারে নানা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
পরিশিষ্ট:
নবজাতকের মা হিসেবে কি আপনি আপনার পুষ্টি নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল?
নিয়মিত আপনি কি পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাবার খান? বাস্তবতা হল, এদেশের
অনেক মায়েরা সন্তান
জন্মের পর সন্তানের লালন পালনে নিজেদের ব্যস্ত করে রাখেন। সময়মত নিজেদের খাবারের কথা্ও তাদের মনে থাকে না। সেজন্য
মাকে নিজে এবং পরিবারের সবাইকে এদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। নবজাতক মায়ের দুধ থেকে সবধরনের পুষ্টিগুন পেয়ে থাকে। মা-ই যদি ঠিকমতো এবং পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাবার না খান
তাহলে শিশু কিভাবে তার পুষ্ট পেতে পারে? আপনার সন্তানের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের
জন্যই মা হিসেবে এমন
সব
খাবার খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত যা পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ। আপনার নবজাতকের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আপনার সঠিক
খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যেই নিহিত।
আমাদের কেয়ার লাইনে
ফোন করে রবি থেকে বৃহস্পতিবার (সরকারী ছুটির দিন বাদে) সকাল ৯টা থেকে বিকাল
৫টা পর্যন্ত সুপারমম এর ডাক্তারদের সাথে সরাসরি পরামর্শ করতে পারেন মা ও শিশু
বিষয়ক যেকোন সমস্যা নিয়ে।
আমাদের নাম্বার ০৮-০০০-৮৮৮-০০০