বাচ্চাকে কথা বলা শেখাবার টিপস
শিশুর জন্মের কয়েক মাস পর থেকে বাবা-মা সহ আত্মীয় স্বজনদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায় বাচ্চাদের মুখে
ফোটা প্রথম বুলি। সবাই গভীর আগ্রহে বাচ্চার মুখ থেকে
বিভিন্ন আওয়াজ শোনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাচ্চাটি হয়ে ওঠে তখন পরিবারের মধ্যমণি।
তবে সব বাচ্চাই এক সময়ে কথা বলা
শেখেনা। কিছু
পদ্ধতি অবলম্বন করে শিশু কথা বলাকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।
বাবা মায়েরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন
হলে বাচ্চাকে কথা শেখানোর সকল প্রাথমিক করনীয় গুলো মেনে চলা উচিৎ। যেমন-
১। শিশুর সাথে প্রচুর কথা বলা
শিশুরা খুবই অনুকরণপ্রিয়। বাচ্চারা সব সময় বড়দের অনুকরণ করতে
চায়। বিশেষ করে বাবা-মার সাথে শিশুরা সব
সময় হাসি ঠাট্টা আর খেলায় মেতে থাকে। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর সময় বাবা মাকে অবশ্যই শিশুর সাথে কথা বলার চেষ্টা
করতে হবে। শিশুর সাথে প্রচুর কথা বলা শিশুকে
কথা শেখানোর উৎকৃষ্ট পন্থা। পরিবারের সদস্যদেরও শিশুর সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে প্রচুর কথা বলতে হবে। শিশুকে এমন প্রশ্ন করতে হবে যার উত্তর সে ছোট ছোট শব্দ বা বাক্যে অথবা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দিতে পারে।
অনেকেই শিশুকে টিভি দেখতে বসিয়ে দেন।
তা না করে তাকে গল্পের বই পড়ে শোনান। শিশুকে গল্পের ফাঁকে বিভিন্ন রকম
আওয়াজ করানোর চেষ্টা করতে হবে।
২। গান বা ছড়া শোনান
বাচ্চাকে কথা সেখানোর আরেকটা কার্যকরী
উপায় হলো শিশুকে ছড়া বা গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো। গানের অর্থ বা কথা না বুঝলেও শিশুদের
অন্তর্নিহিত একটা ছন্দবোধ থাকে। সেই গানের ছন্দে শিশুদের ঘুম আসে আবার গান মনের মাঝে বাজতেও থাকে। ফলে শিশুরা গানের সাথে সাথে চেষ্টা
করে গানটা গাওয়ার।
শিশুকে গান শোনান বা ছন্দবোধ্য ছড়া-কবিতা
শোনান।
নিজে না পারলে মিউজিক সিস্টেমের সাহায্য নিন।
আপাতদৃষ্টিতে এটা শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম মনে হলেও শিশুর কথা পরিষ্কারভাবে বলতে সাহায্য করে।
৩। শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ অনুকূল রাখুন :
শিশুকে সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশে
বেড়ে উঠতে দিন।
শিশুর সামনে তর্ক বা ঝগড়া করবেন না।
কোনো ব্যাপারে দ্বিমত হলে তা শিশুর সামনে প্রকাশ করা যাবে না। শিশুকে যতটুকু সম্ভব হাসি খুশির
মধ্যে রাখতে হবে। শিশু কান্না কাটি করলে অস্থির হলে
চলবে না। শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে হালকাভাবে
চেষ্টা করতে হবে যাতে সে আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসে। বাবা মায়ের ঝগড়া শিশুর কোমল মনে আঘাত
হানতে পারে। এতে করে শিশু অবস্থায় বাচ্চারা এক
ধরণের মানসিক চাপ বা আঘাত প্রাপ্ত হতে পারে যা বাচ্চার কথা বলায় বা অন্যান্য
স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যঘাত করতে পারে।
৪। উচ্চারণ শুধরে দিন :
শিশুকে সব সময় শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা
সেখানোর চেষ্টা করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই
ভুল উচ্চারণে কথা বলা শেখালে পরবর্তীতে শিশুর কথা বলায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তাই শিশুর ভুল উচ্চারণে ভাঙা ভাঙা কথা শুনতে ভালো লাগলেও তাকে উৎসাহ দেবেন না।
শিশুর ভুল উচ্চারণ শুনে খুশি না হয়ে বরং তা তৎক্ষণাত তা শুধরে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। এতে করে বাচ্চারা ভুল উচ্চারণে কথা
বলতে নিরুৎসাহ বোধ করবে। বাচ্চার
উচ্চারন হবে অনেক শ্রুতিমধুর এবং কথা বলা হবে আরও বেশি স্পষ্ট।
৫। বাচ্চাকে সময় দিন :
বাবা-মাকে শিশুর প্রতি যথেষ্ট সময়
দিতে হবে। বর্তমান সময় হলো শুধুই ছুটে চলার। কর্মজীবী মহিলাদের সন্তানের প্রতি
যত্ন নেয়া বা পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করার অবকাশ খুবই অল্প। এরই মাঝে বাবা-মার শিশুর প্রতি সময়
বের করে নিতে হবে। শিশুর সাথে খেলা ধুলা করতে হবে। শিশু বুঝুক আর নাই বুঝুক শিশুর সাথে
প্রতিনিয়ত কথা বলতে হবে। শিশুর মা-বাবা
যতটা সম্ভব শিশুর সাথে সুন্দর সময় কাটানোর চেষ্টা করুন, বাচ্চা যেন হীনমন্যতায় না ভোগে বা নিজেকে অসহায় না ভাবে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
৬। স্পিচ থেরাপি
বাচ্চা ঠিক বয়সে কথা বলা না শিখলে
সেটা বাবা মায়ের জন্য একটা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেসব শিশু কথা বলা শিখছে না বা দেরিতে বলছে বা ভালো করে বলতে পারছে না, তাদের জন্য বাবা মায়ের আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে।স্পিচ থেরাপির ব্যাপারটি অনেকের কাছেই
অজানা। স্পিচ থেরাপির সহায়তা নিলে শিশু অনেক দ্রুত কথা বলা শিখতে পারে।
যথাসময়ে কথা বলা না শিখলে স্কুল থেকে শুরু করে সামাজিক কর্মকাণ্ডে শিশুটি অনগ্রসর হয়ে পড়বে যা তাকে সারা জীবনের প্রতি পদে বাধার সম্মুখীন করবে।
৭। নির্দিষ্ট শব্দের ওপর জোড়
অনেক সময় যেসব শিশু কথা বলতে পারে না
বা দেরিতে কথা বলে সেসব ক্ষেত্রে প্রতিটি
কাজে একটি নির্দিষ্ট শব্দের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতে হবে।
যেমন- শিশুকে গোসল করানোর সময় 'গোসল'
শব্দটির ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
আবার বাইরে যাওয়ার সময় 'যাব'
শব্দটি বারবার বলে শিশুকে বোঝাতে হবে।
৮। ইশারায় কথা বললে
শিশু যদি ইশারার সাহায্যে কথা বলতে চায়, তবে সেই ইশারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং অর্থবোধক শব্দ যোগ করে তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করুন।
যেমন- শিশু বিদায় জানাতে হাত বাড়ালে আপনি বলুন 'বাই বাই' অথবা
'টা টা'। শিশুকে প্রতিটি মুহূর্তে ইশারার সাথে
সাথে মুখে আওয়াজ করে সেই ইশারার সঙ্গতিপূর্ণ আওয়াজ করতে হবে।
৯। খেলার ছলে কথা শেখানো
শিশুকে অনেক সময় খেলার ছলেও কথা
শেখানো যায়। যেমন শিশুর সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় রেখে (শিশুর নাগালের বাইরে) তাকে জিনিসটি দেখান।
যখন সে ওটা নিতে চাইবে বা আপনার হাত ধরে টানবে, তখন আপনি জিনিসটির নাম একটু স্পষ্টভাবে বলুন।
যেমন- যদি 'গাড়ি'
হয় তবে বলুন 'ও, তুমি গাড়ি
খেলতে চাও?' অথবা
'এই যে তোমার গাড়ি।'
শিশুর অনুকরণের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর বেশি গুরুত্ব দিন।
যেমন- শিশুর হাসি বা মুখভঙ্গির অনুকরণ করে দেখান।
তারপর আপনার সঙ্গে শিশুকে অন্যান্য শারীরিক অঙ্গভঙ্গি যেমন- হাততালি দেওয়া, হাতের উল্টো পিঠে চুমু খাওয়া ইত্যাদি করান।
১০। প্রতিকী শব্দের ব্যবহার
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু মূল শব্দের আগে প্রতীকী শব্দ ব্যবহার শুরু করে।
তাই এ ক্ষেত্রে আপনিও
প্রাথমিকভাবে প্রতীকী শব্দ ব্যবহারে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন। যেমন-
গাড়ি বোঝাতে পিপ পিপ। বেড়াল বোঝাতে
মিঁউ মিঁউ ইত্যাদি।
যেসব শিশু মাঝেমধ্যে দু-একটি
শব্দ বলছে, তাদের শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির ওপর জোর দিন।
যেমন- শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (মাথা, হাত, পা),
বিভিন্ন জিনিসের নাম (বল,
গাড়ি, চিরুনি), বিভিন্ন ক্রিয়াবাচক শব্দ (খাব, যাব,
ঘুম) ইত্যাদি শেখান।
১১। ছবির মাধ্যমে কথা শেখানো
দুই বছরের বড় শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত এবং অতি পছন্দের ৮-১০টি
ছবি নিয়ে একটি বই তৈরি করুন।
প্রতিদিন একটু একটু করে বই দেখিয়ে শিশুকে ছবির মাধ্যমে নাম শেখাতে পারেন।
১২। মনোযোগ বৃদ্ধির চেষ্টা
যেসব শিশু চোখে চোখে তাকায় না এবং মনোযোগ কম, আবার কথাও
বলছে না, তাদের ক্ষেত্রে
আগে চোখে চোখে তাকানো ও মনোযোগ বৃদ্ধির
বিভিন্ন কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন- লুকোচুরি খেলা, কাতুকুতু দেওয়া, চোখে চোখে তাকিয়ে শিশুর পছন্দের ছড়াগান অঙ্গভঙ্গি করে গাওয়া।
শিশুর কথা বলা শেখাতে যা করা যাবে না
১। শিশুকে কথা বলার জন্য অত্যধিক চাপ যেমন- 'বল, বল'
ইত্যাদি একেবারেই করা যাবে না।
২। বাবা মায়ের এক ধরণের প্রবণতা বেশী
দেখা যায় সেটা হল শিশুকে একসঙ্গে
অনেক শব্দ শেখানোর চেষ্টা করা। এতে শিশু কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।
স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাব্যবস্থা। সঠিক
সময়ে এই পদ্ধতির কৌশলগত প্রয়োগ হলে শিশু কথা এবং যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে উন্নতি করবেই।
৩।শিশুকে অযথা অপ্রাসঙ্গিক অথবা অতিরিক্ত প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪।অনেক মা-বাবাই
ভাবেন, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে তাদের পিছিয়ে পড়া শিশুর খেলার পরিবেশ করে দিলেই আপনা আপনিই কথা শিখে যাবে।
কিন্তু মনে রাখবেন, এমনটা না-ও
হতে পারে।
তাই নিজেরা বাড়িতে চেষ্টা করুন, প্রয়োজনে স্পিচ থেরাপির সহায়তা নিতে হবে।
পরিশিষ্ট
উপরের টিপসগুলো যে বাচ্চারা একটু
দেরিতে কথা শেখে তাদের জন্য প্রজোয্য। তবে মানসিক বা শারীরিক কোন প্রতিবন্ধকতার
কারণে বাচ্চা কথা না বললে সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
আমাদের কেয়ার লাইনে ফোন করে রবি থেকে বৃহস্পতিবার (সরকারী ছুটির দিন বাদে) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সুপারমম এর ডাক্তারদের সাথে সরাসরি পরামর্শ করতে পারেন মা ও শিশু বিষয়ক যেকোন সমস্যা নিয়ে। আমাদের টোল ফ্রি নাম্বার ০৮-০০০-৮৮৮-০০০
সর্বাধিক জনপ্রিয় আর্টিকেল
-
বাচ্চাকে কথা বলা শেখাবার টিপস
-
বাচ্চার সাথে খেলার আইডিয়া খুঁজে পাচ্ছেন না? এই ৭ টি ট্রাই করুন
-
কোন বয়সে বাচ্চার কি করতে পারা উচিৎ- বেবি এবিলিটি চার্ট
-
বাচ্চাকে টিভি আর গেমসে অভ্যস্ত করছেন? পরিণামটাও জেনে নিন তাহলে!
-
জেদী বাচ্চাকে সামলে রাখার ১০টি টিপস
-
মা আর বেবির বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলার ৫টি টিপস।
-
বাচ্চার বুদ্ধিমত্তা ডেভেলপ করার ১০টি টিপস