বাসায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো থেকে আপনার বাচ্চা কতটুকু নিরাপদ? যাচাই করে নিন আজই।

আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন যে কেটে যাওয়া, পড়ে যাওয়া, ছ্যাকা লাগা ইত্যাদি সব হিসাব করলে দেখা যায় বাচ্চারা ঘরের ভেতরেই সব চেয়ে বেশি ব্যাথা পাচ্ছে। এটি হবার কারণ মাত্র দুটি। প্রথমত এই যে বাচ্চা এখনও বুঝতে শেখেনি কিসে ব্যাথা পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয়ত আমাদের বাড়ি বানানো এবং সাজানোর কাজটা বড় মানুষদের, আর আমরা এটি করার সময় আমরা ভুলেই যাই যে বাসায় তো বাচ্চারাও থাকতে পারে।

প্রথম কারনের জন্য বাচ্চাকে আস্তে আস্তে বোঝাতে হবে। আর দ্বিতীয়টি ঠিক করতে গেলে আপনার ঘরটাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন বাচ্চা নিরাপদ থাকে।

আপনার বাসায় যদি ছোট বাচ্চা থাকে, তাহলে ঘরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা থেকে ওকে নিরাপদ রাখার জন্য নিচের এই ৯টি টিপস ফলো করুন।

) পড়ে যাওয়া

উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গিয়ে বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি ব্যাথা পায়। বাচ্চারা যখন থেকে হামাগুড়ি দিতে শিখছে তখন থেকেই এই ভয় শুরু। এর থেকে সাবধান হবার জন্য আপনার বিছানার পাশে ম্যাট বিছিয়ে রাখুন। খেয়াল করবেন যাতে ম্যাট টি পিছলে না যায় এমন হয়। এছাড়া কোন চেয়ার খোলা অবস্থায় রেখে দেবেন না। টেবিলের গ্যাপে চেয়ার ঢুকিয়ে রাখুন। বাসায় কোন উঁচু টুল রাখবেন না, আর রাখতে হলে তা বাচ্চার নাগালের বাইরে স্টোর রুমে গুছিয়ে রাখবেন।

আপনার বাসার বারান্দায় গ্রিল লাগানো না থাকলে এখনি ব্যবস্থা নিয়ে এটি করে ফেলুন। এছাড়া যদি সিঁড়িতে রেলিং না থাকে তাহলে বাচ্চাকে একা কোন অবস্থাতেই নামতে দেবেন না। একই কথা বাসার ছাদের ক্ষেত্রেও।

) পুড়ে যাওয়া

বার্ন ইনজুরি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মারাত্নক হয়ে ওঠে। ঘরের ভেতরে এর প্রধান উৎস হচ্ছে গরম পানি, চা এর কাপ বা কেটলি, এবং গরম ডাল-তরকারি ইত্যাদি।

এর থেকে সাবধান হবার জন্য রান্নাঘরে চুলায় গরম পানি বসিয়ে কখনো এটি রেখে চলে আসবেন না। হয় রান্না ঘরের দরজা বন্ধ রাখুন (তবে জানালা/ভেন্ট খোলা রাখবেন), অথবা বাচ্চাকে সামলে রাখুন। গরম পানি নিয়ে যাবার সময় বাচ্চাকে অন্য ঘরে সামলে রেখে তারপর নেবেন।

গরম চা ভর্তি কাপ/কেটলি, অথবা টেবিলে গরম ডাল-তরকারি রেখে চলে যাবেন না। এগুলো আনা নেয়া এবং রাখার সময় অবশ্যই বাচ্চার কথা খেয়াল রাখুন।

 

আয়রন (ইস্ত্রি), ইলেক্ট্রিক টোস্টার, এয়ার ফ্রাইয়ার, স্যান্ডুউইচ মেকার ইত্যাদি কোন কিছুই সকেটে সারাক্ষন লাগিয়ে রাখবেন না। ব্যবহার শেষে এটি রান্না ঘরে গুছিয়ে রাখুন যাতে বাচ্চা এর কাছে এসে ছ্যাকা না পায়। এছাড়া ম্যাচ বা লাইটার ইত্যাদি ব্যবহার শেষে নিরাপদ জায়গাতে গুছিয়ে রাখুন।

) বিষাক্ত কিছু খেয়ে ফেলা বা সংস্পর্শে আসা

ওষুধ খেয়ে ফেলা বাচ্চার জন্য খুবই স্বাভাবিক। তাই ট্যাবলেট ইত্যাদি একটা বক্সে রেখে তা বাচ্চার নাগালের বাইরে রাখবেন। সিরাপ ইত্যাদির বটল গুছিয়ে রাখুন। এছাড়া বাসায় ব্যবহৃত এয়ার ফ্রেশনার, এরোসল, টয়লেট ক্লিনার, গ্লাস ক্লিনার, ইত্যাদি যেন বাচ্চা নাগালে না পায় এটি খেয়াল রাখুন।

একই কথা প্রযোজ্য বাসায় ব্যবহৃত প্রসাধন সামগ্রী সম্পর্কে। কারণ লোশন, লিপস্টিক, ক্রিম ইত্যাদি যেকোনো কিছুই বাচ্চা খেয়ে ফেললে বিপদ হতে পারে। তাই এগুলোও গুছিয়ে রাখবেন।

বাসায় কেউ ধূমপায়ী থাকলে তাকে বলুন সিগারেট বাইরে থেকে খেয়ে আসতে (ছেড়ে দিতে পারলেই বেস্ট) কারণ সিগারেট ফেলে দেয়া অংশ অ্যাশট্রে থেকে নিয়ে বাচ্চা মুখে দিয়ে দিতে পারে।

) কেটে যাওয়া

চকচকে ধারালো জিনিস দেখলে বাচ্চাদের কি আর মানানো যায়? ওরা তো এটি ধরতেই চাইবে। আপনার সামনে করতে গেলে তো আপনি বকা দেবেন, তাই আপনার আড়ালে চান্স পেলে ওরা এটি ধরবেই। রান্নাঘরে ছুরি-কাচি, বটি কখনোই খোলা রাখবেন না। ব্যবহার শেষে অবশ্যই গুছিয়ে রাখবেন বক্স অথবা ড্রয়ার এর মধ্যে। বাচ্চা একটু বড় হয়েই ড্রয়ার খোলা শিখে যাবে, তাই লক ব্যবহার করুন, বা রান্নাঘরের দরজা বন্ধ রাখুন।

বাচ্চাকে যেসব খেলনা দিচ্ছেন সেগুলো তে কোন ধারালো অংশ নেই এটা নিশ্চিত করে নিন।। এছাড়া বাসার কাচের জিনিস যেমন কাপ পিরিচ অথবা প্লেট, বাটি ইত্যাদি ব্যবহারে সাবধান হউন। কাঁচের জগের বদলে ফুড গ্রেড প্লাস্টিক জগ ব্যবহার করুন।

বাচ্চার হাত কেটে যাবার আরেকটি উৎস হচ্ছে টেবিল ফ্যান তাই বাচ্চা অন্তত বছর বয়সি না হওয়া পর্যন্ত বাসায় টেবিল ফ্যান রাখবেন না

) ফার্নিচারের থেকে ব্যাথা পাওয়া।

বাচ্চা জোরে হাঁটা বা দৌড়ানো শিখে ফেলার পর শুরু হয় ধাক্কা লেগে ব্যাথা পাওয়া। যেমন টেবিলের কোনায় বাড়ি লেগে কপাল কেটে যাওয়া খুবই কমন একটি দুর্ঘটনা। বাসার টেবিলগুলোর কোনাগুলো রাউন্ডেড না হলে হয় টেবিলটি বদলে ফেলুন, অথবা টেবিলের কর্নারে প্যাড লাগিয়ে নিন। খাটের নিচে যদি বাচ্চা ঢুকে পড়তে পারে এমন জায়গা থাকে তবে তা ব্যাগ ইত্যাদি ঢুকিয়ে বন্ধ করে ফেলুন।

শোকেস, টিভি ট্রলি, ডিনার ওয়াগন ইত্যাদিতে কাঁচের দরজা থাকলে তা খুলে রাখাই বেস্ট সল্যুশন। কারণ বাচ্চা হঠাত দৌড়ে এসে ধাক্কা লাগলে কাঁচ ভেঙ্গে বাচ্চার ওপর পড়তে পারে।

আর বাসার ফার্নিচার এমন ভাবে সাজানোর চেষ্টা করুন যেন ওর চলাচলের পথে ধাক্কা লাগা যতটা সম্ভব এড়ানো যায়। এটি করতে গিয়ে যদি ঘরের সৌন্দর্য নষ্টও হয়, তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করবেন যে কী আপনার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট। বাচ্চা নিরাপদে রাখা নাকি বাসা সুন্দর রাখা?

) পা পিছলে পড়া/আছাড় খাওয়া

ঘরের মেঝে সাধারণত মসৃণ ফিনিশিং থাকে। তাই আপনার ব্যবহৃত ম্যাট গুলো যাতে গ্রিপ ভাল থাকে, অর্থাৎ পিছলে যাবেনা এমন দেখে কিনুন। কখনই কাপড় এখানে সেখানে ফেলে রাখবেন না। কারণ ফ্লোরে পড়ে থাকা কাপড়ে পা দিয়ে বাচ্চা পিছলে পড়তে পারে।

ঘর মোছার পর না শুকানো পর্যন্ত বাচ্চাকে সামলে রাখুন। অথবা বাচ্চা একঘরে রেখে অন্য ঘর মুছবেন। বাথরুমের ফ্লোরে যেন পানি জমে না যায় এর জন্য বাথরুম ফ্লোর শুকনো করতে মপ ব্যবহার করে নিন।

) পানিতে ডুবে যাওয়াঃ

আগে বাচ্চারা ডুবে যেত পুকুরে। আর এখন এর সাথে যোগ হয়েছে বাথরুমের বালতি অথবা বাথটাব। আপনার বাসায় পানির সঙ্কট না থাকলে বালতিতে পানি জমিয়ে রাখা বন্ধ করুন। প্রতিবার ব্যবহার শেষে বালতি উপুর করে রাখুন। আর পানি যদি ধরে রাখতেই হয় তাহলে বাসার যেকোনও একটা বাথরুমে পানি ধরে রাখুন এবং সেটি সবসময় তালাবন্ধ করে রাখুন। লক লাগানো না গেলে ছিটকিনি ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া যে বাথরুমে বাথটাব আছে, সেটিও বন্ধ রাখুন প্রতিবার ব্যবহারের পর।

) দরজায় ব্যাথা পাওয়া অথবা রুমে আটকে যাওয়া

দরজার ফাকে হাত ঢুকিয়ে আপনার বাচ্চার আঙ্গুল থেঁতলে যেতে পারে, অথবা জোর বাতাসে হঠাত দরজা লেগে গিয়ে সে ব্যাথা পেতে পারে। তাই বাসার রুমগুলোর দরজা হয় বন্ধ রাখুন আর খোলা রাখার সময় অবশ্যই দরজা যেন নিজ থেকে লেগে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা রাখুন।

বাচ্চা একটু বড় হবার পরে লক করা এবং ছিটকিনি বন্ধ করতে চাইবে। অনেক সময় বাথরুমে বা অন্য রুমে গিয়ে বাচ্চা দরজা লক করে ফেলে কিন্তু আর খুলতে পারেনা। হয়তো লক নষ্ট অথবা আপনি চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না। এটি এড়াবার জন্য বাসার দরজার লকগুলো ভালমানের লাগিয়ে নিন যাতে সহজে নষ্ট না হয়, এবং বাচ্চার নাগালে থাকা ছিটকিনি গুলো খুলে ফেলুন। লকের চাবির দুই সেট আলাদা জায়গায় এমন ভাবে রাখুন যাতে বাচ্চা নাগাল না পায় এবং আপনি সহজেই খুঁজে পান।

) ইলেক্ট্রিক শক

বাসায় খোলা সকেট, মাল্টি-প্লাগ, এবং খোলা ওয়ারিং হচ্ছে সবচেয়ে বিপদজনক। কৌতুহল থেকে বাচ্চারা এগুলো ধরবেই। এছাড়া বাচ্চা ছোট অবস্থায় ওদের আঙ্গুল এতটাই চিকন থাকে যে অনেক সকেটের মধ্যে সহজেই আঙ্গুল ঢুকিয়ে ফেলতে পারে।আর চা চামচের হ্যান্ডল অথবা অন্য কোন ধাতব কিছুও সেখানে ঢুকিয়ে দেখতে চাইতে পারে।

ইলেক্ট্রিক শক থেকে প্রটেক্ট করার জন্য বাসায় মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে খুব সাবধানী হউন। কোন অবস্থাতেই টিভি অথবা ওভেন ইত্যাদি সকেট থেকে দূরে বসাবার জন্য মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করবেন না। ইলেক্ট্রিশিয়ান ডেকে ওয়ারিং সকেটিং করে নিন, এবং এই ওয়ারিং যেন ভালমানের হয় তা খেয়াল রাখবেন। বাসার কোন জায়গা দিয়ে খোলা তার গেলে তা অবশ্যই চ্যানেল লাগিয়ে কভার করে নিন।

যেই সকেটগুলো বাচ্চার নাগালে সেগুলো হয় পারমানেন্টলি বন্ধ করে ফেলুন, অথবা সকেট ক্লোজার বা কভার লাগিয়ে রাখুন যা আপনি দরকারের সময় খুলে ব্যবহার করতে পারেন। এখন সেফটি সকেট বের হয়েছে যেগুলো চাইল্ড লকিং থাকে

১০)দমবন্ধ হয়ে যাওয়াঃ

শপিং ব্যাগ এবং বাজারের ব্যাগ বা পলিথিন যে আপনার বাসায় কী পরিমাণ জমে তা কখনো দেখেছেন? এই ব্যাগগুলোর ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে ফেললে বাচ্চারা দমবন্ধ হয়ে মারাও যেতে পারে। তাই কোন অবস্থাতেই শপিং ব্যাগ, পলিথিন ইত্যাদি যেখানে সেখানে ফেলে রাখবেন না। বাসায় যে কয়টা ব্যাগ দরকার শুধু সেই কয়টাই গুছিয়ে রাখুন, আর বাকি যা আসবে প্রতিদিন ফেলে দিন।

পরিশিষ্ট

শুরুতেই বলেছি যে ঘরের ভেতরেই বাচ্চারা ব্যাথা বেশি পেয়ে থাকে। বাচ্চার কৌতুহল আর ছোটাছুটি আপনি থামাতে পারবেন না, কিন্তু এই আর্টিকেলে বলা টিপসগুলো মেনে চললে আপনি আপনার বাসাটাকে অনেকটাই নিরাপদ করে তুলতে পারবেন।

এবার আপনার কথা বলুন, বাচ্চা ব্যাথা পেতে পারে এমন কোনকিছু কি আমরা বাদ দিয়ে গিয়েছি? অথবা আপনার বাচ্চাকে নিরাপদে রাখার জন্য আপনি কি এর বাইরে কোন পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছেন? আপনার এক্সপেরিয়েন্স এর কথা কমেন্ট করে আমাদের সাথে শেয়ার করলে সব মা-বাবারাই উপকৃত হবেন

আমাদের কেয়ার লাইনে ফোন করে রবি থেকে বৃহস্পতিবার (সরকারী ছুটির দিন বাদে) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সুপারমম এর ডাক্তারদের সাথে সরাসরি পরামর্শ করতে পারেন মা শিশু বিষয়ক যেকোন সমস্যা নিয়ে আমাদের নাম্বার ০৮-০০০-৮৮৮-০০০