শিশুর মানসিক বিকাশে বিনোদনের ভূমিকা

মোঃ খালেদ বিন চৌধুরী ।। সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

যদিও শিশু খুব অসহায় পরনির্ভরশীল অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে কিন্তু ধীরে ধীরে তার বিকাশ অর্থাৎ গুণগত পরিবর্তন হতে শুরু করে। মানসিক বিকাশ বলতে আমরা বুঝি বুদ্ধিগত দক্ষতায় পরিবর্তন। এর মধ্যে মনোযোগ, স্মরণশক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাত্যহিক জীবনের জ্ঞান, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, চিন্তার দক্ষতা, যুক্তি দিয়ে বোঝার ক্ষমতা বোঝায়। অন্যদিকে বিনোদন বলতে সেসব কর্মকাণ্ডকে বোঝায় যা মানুষের ক্লান্তি, একঘেয়েমি দূর করে আনন্দপূর্ণ জীবন পেতে সাহায্য করে। খেলাধূলা, বনভোজন, দৌড়ঝাপ, নাচ গানে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিনোদনের অন্তর্ভুক্ত।

পৃথিবীর সব দেশের শিশুদের কিছু বিশেষ অধিকার রয়েছে। শিশু অধিকারগুলো হলো : . জন্ম নিবন্ধনের অধিকার ২. একটি নাম পাওয়ার অধিকার ৩. স্নেহ ও ভালবাসা পাওয়ার অধিকার ৪. পুষ্টি ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার ৫. খেলাধূলা ও বিনোদনের অধিকার ৬. শিক্ষার অধিকার ৭. মেয়ে ও ছেলে শিশুর সমান সুযোগ লাভের অধিকার ইত্যাদি। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠার জন্য এসব অধিকার পূরণ হওয়া খুবই প্রয়োজন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো শিশুদের এসব অধিকার পূরণ করা।

বাংলাদেশে শিশুদের বিনোদনের অধিকারসহ মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় শিশুনীতি, ২০১১ বাংলাদেশের শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যত বিনির্মাণে একটি সুদূরপ্রসারী রূপকল্প। এ নীতির ৬ ধারায় শিশুর বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে শিশুর জন্য মানসম্পন্ন বিনোদন, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য খেলার মাঠ, খেলার সরঞ্জাম রাখা, এলাকাভিত্তিক শিশু পার্ক স্থাপন এবং নগর পরিকল্পনায় আবশ্যিকভাবে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দুর্যোগকালীন সময় এবং তার পরবর্তীতে আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিনোদনমূলক কার্যক্রমের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং লাইব্রেরি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তাদের উপযোগী বিনোদনের ব্যবস্থা করা হবে।

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত- কথাটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। অনেক সময় অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের চাপে শিশুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার বিনোদনের ব্যাপারটি প্রায় উপেক্ষিত থাকছে। শহরজুড়ে শিশুদের পোশাক, খেলনার দোকান, পার্ক, স্কুল, গাননাচ শেখার কোচিং থাকলেও প্রকৃত বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শিশুর বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে খেলাধূলা। কিন্তু খেলার মাঠ বা বাড়ির সামনের উঠানের দেখা মেলে না সহজে। গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাঠ থাকলেও শহরে তেমন দেখা যায় না। আবার যেখানে মাঠ আছে সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে খেলাধূলার সুযোগ নেই শিশুদের।

স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজলেই তাদের দৌড়াতে হয় কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে। বইয়ের ভারে ক্লান্ত শিশুরা সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। এত কিছুর মাঝে খেলার সময় আর হয় না। তাই বিনোদনের জন্য শিশুদেরও খুঁজতে হচ্ছে অন্যকিছু।

সচ্ছল পরিবারগুলো সন্তানদের আগ্রহী করছে কম্পিউটার গেমসের প্রতি। অন্যদেরও বিনোদনের একমাত্র উপায় টেলিভিশন। বিগ গানের এ যুগে স্যাটেলাইট চ্যানেলের অবাধ প্রসার ঘটলেও শিশুরা অবহেলিত রয়ে গেছে। শিশুরা সুস্থ বিনোদনের জগৎ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কারণ শিশুতোষ কোন টেলিভিশন চ্যানেল এখানে নেই। শিশুরা কার্টুনের জন্য ঝুঁকছে ভিনদেশি চ্যানেলের প্রতি। এতে শিশুদের দেশি সংস্কৃতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরির পাশাপাশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন বাড়ছে। ফলে শিশুদের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

উদ্ভুত এ বিপজ্জনক পরিস্থিতির প্রতিকার জরুরি। দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশে এখনো খুব বেশি কার্টুন সিরিজ তৈরি হয়নি। ইউনিসেফের মীনা কার্টুনটি এক সময় শিশুদের মাঝে খুব জনপ্রিয় ছিল। এখন সেটাও আর নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে না।

মন্টুমিয়ার অভিযাননামে থ্রিডি কার্টুন যাত্রা করলেও কিছুদিনের মাঝে হারিয়ে যায় সেটিও। বাংলাদেশে কার্টুনের অপ্রতুলতার কারণে স্বাভাবিকভাবে শিশুরা বিদেশি কার্টুনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল হিন্দিতে ডোরেমনসিরিজ কার্টুনটি, যা ভারতীয় চ্যানেলে দেখানো হতো। কার্টুন দেখতে দেখতে বাচ্চারা নিজ মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি ঠেকাতে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। অনেকটা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা। এ চ্যানেল বন্ধ করার পর থেকে এখনো শিশুদের জন্য কোনো বিনোদন এর বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে পারা যায়নি। বাংলায় তৈরি হয়নি কোন কার্টুন। শুধু কার্টুন নয়, শিশুতোষ অনুষ্ঠানেরও বেশ ঘাটতি রয়েছে। মুস্তফা মনোয়ারের মনের কথাকিংবাসিসিমপুরএর মতো শিশুতোষ অনুষ্ঠান একেবারেই হাতেগোনা। বিনোদনের আরেক বড় মাধ্যম শিশুতোষ চলচ্চিত্রের অবস্থা আরো শোচনীয়। বিদেশে প্রতিবছর শিশুদের জন্য অসংখ্য ছবি বের হয় এবং এগুলো ব্যবসা সফলও। কিন্তু এদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নেই বললেই চলে। দিপু নাম্বার টু, এমিলির গোয়েন্দা বাহিনী কিংবা আমার বন্ধু রাশেদ এর মতো চলচ্চিত্র শিশুদের মানসিক ও মানবিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। সর্বোপরি শিশুর বিনোদনের জন্য অভিভাবক থেকে শুরু করে সরকার, মিডিয়া, চলচ্চিত্র নির্মাতা সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে; যার মাধ্যমে শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশ সম্ভব। কারণ বিনোদন কেবল নিছক আনন্দ নয় বরং এর মাধ্যমে শিখন, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়।

খেলাধূলা ও শিশুর বিকাশের জন্য আবশ্যক। খেলাধূরা শিশুদের সৃজনশীলতা ও আত্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সৃষ্টি করে। শিশুরা যখন সমবয়সীদের সাথে খেলাধূলা করে, তখন তারা নিজেদের সামর্থ্য ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং অন্যেরও সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে পারদর্শী হয়।

মা-বাবারাও শিশুদের খেলার সাথী হতে পারেন। এতে পিতা-মাতা ও সন্তানদের মধ্যে বারো বোঝাপড়া তৈরি করতে সাহায্য করে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সময়ে সাফল্য ও জয়কে বড় করে দেখা হয়। এ মনোভাব শিশুদের মধ্যে হতাশা তৈরি করতে পারে। জয়লাভের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অংশগ্রহণের মাধ্যমে আনন্দ লাভ করা। এটাই হবে শিশুদের জন্য আনন্দময় জীবন। সবশেষে বলা যায়, যথাযথ বিনোদনই পারে শিশুর প্রকৃত বিকাশ ঘটাতে।

অনুসন্ধান এর বিষয়

প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল